📖 Index (সূচিপত্র)👇
১. মানুষ-জমির অনুপাত ও জনঘনত্ব
(Man-Land Ratio and Density of Population)
২. পৃথিবীর জনসংখ্যার বণ্টন
(World Distribution of Population)
৩. পৃথিবীতে অসম জনসংখ্যা বণ্টনের কারণসমূহ
(Causes of Uneven Distribution of World Population)
৪. পৃথিবীর জনসংখ্যার আঞ্চলিক বণ্টন
(Regional Distribution of World Population)
৫. পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি
(Trend of Growth of World Population)
৬. পরিব্রাজন (Migration)
৭. জনসংখ্যা বিবর্তন বা পরিবর্তন তত্ত্ব বা মডেল
(Demographic Transition Model)
৮. ভারতের জনবিন্যাস ও জনঘনত্ব
(Population Density of India)
৯. ভারতে জনসংখ্যা বণ্টনের তারতম্যের কারণসমূহ
১১. মানব সম্পদ সম্পর্কে ধারণা
(Concept of Human Resource)
১০. জনঘনত্ব অনুযায়ী ভারতের রাজ্যগুলির শ্রেণিবিভাগ
(Classification of Indian States according to Population Density)
✅Highlights Points & Question Answer
১১. জনবসতি (Settlement)
✅Highlights Points & Question Answer
জনসংখ্যা ভূগোল Notes in Bengali
বিজ্ঞানের ভাষায় জনসংখ্যা হল একই প্রজাতিভুক্ত সমস্ত জীবের একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একত্রিত সমাবেশ। তবে ভূগোলে জনসংখ্যা বলতে মানুষ-জনসংখ্যা বা লোক-জনসংখ্যাকে বোঝানো হয়। পৃথিবীতে 84 লক্ষ জীব প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত জীব প্রজাতির সংখ্যা হল 34 লক্ষ। এর মধ্যে মানুষ একটি জীব প্রজাতি মাত্র । মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হোমো সপিয়েনস্ সেপিয়েনস্ ; আদিম মানুষ প্রজাতি (হোমো ইরেক্টাস, হোমো হ্যাবিলিস) ও আরও প্রাচীন মনুষ্যেতর প্রজাতি (রামা পিথিকাস, ড্রায়ো পিথিকাস, ইজিপ্টো পিথিকাস—মায়োসিন, অলিগোসিন উপযুগ)। আনুমানিক 350 লক্ষ বছর পূর্বে মনুষ্যেতর প্রজাতির উদ্ভব হলেও জনসংখ্যা ভূগোলে 40-20 লক্ষ বছর পূর্বের হোমো সপিয়েনস্ সেপিয়েনস্ মানব প্রজাতির সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়। এই মনুষ্য প্রজাতিটি 35 হাজার বছর পূর্বে আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। জনসংখ্যা ভূগোলে জনসংখ্যা বলতে ‘মানুষ’ নামক এই প্রজাতির মোট মানুষ-জনসংখ্যা বা লোক-জনসংখ্যাকে বোঝানো হয়।
𖤂 ভূমিকা (Introduction) : সমগ্র পৃথিবী মানুষের বাসভূমি হলেও, এর বণ্টন সর্বত্র সমান নয়। মোট জনসংখ্যার প্রায় 80 শতাংশ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যেই বণ্টিত। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে একই প্রজাতিভুক্ত সমস্ত জীবের একত্র সমাবেশকে জনসংখ্যা বা ইংরাজিতে Population বলে। ভূগোলে জনসংখ্যা বলতে মানুষের সংখ্যা ও মানুষকে বোঝায়। মানুষ একটি প্রজাতি। এর বৈজ্ঞানিক নাম হোমোসেপিয়ানস্ সেপিয়ানস্। বস্তুত একে মানব জনসংখ্যা বলা উচিত। আবার গোলার্ধের বিচারে দক্ষিণ গোলার্ধ অপেক্ষা উত্তর গোলার্ধে জনসংখ্যার আধিক্য লক্ষ করা যায়। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় 90 শতাংশ মানুষ বাস করে। এখানেও জনঘনত্বের প্রকৃতি এক নয়। সবচেয়ে বেশি জনঘনত্বপূর্ণ মহদেশ হল এশিয়া যেখানে ঘনত্ব প্রায় 94 জন প্রতি বর্গ-কিলোমিটারে এবং আফ্রিকা মহাদেশে জনঘনত্ব প্রায় 34 জন প্রতি বর্গ-কিমিতে। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত। অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অতি দ্রুত। তাই, তাদের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন সম্পদের জোগান। মানব সম্পদের পূর্ণ বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই বর্ধিত জনগণের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান দেওয়া সম্ভব।
১. মানুষ-জমির অনুপাত ও জনঘনত্ব (Man-Land Ratio and Density of Population) : মানব সভ্যতার বিকাশ ও বিবর্তনের প্রধান দুটি উপাদান হল—মানুষ ও ভূমি। এই দুটি উপাদানের সহযোগিতাপূর্ণ সমন্বয় সাধনের ফলেই মনুষ্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
❶ মানুষ-জমি অনুপাত (Man-land ratio) : মানুষ-জমি অনুপাত বলতে কোনো দেশের বা স্থানের মোট জনসংখ্যার সঙ্গে কার্যকর জমির অনুপাতকে বোঝায়। অধ্যাপক জিমারম্যানের মতে, মানুষ-জমি অনুপাতে প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতির সেইসব দিকগুলি বিবেচনা করা হয়, যা সম্পদ-উৎপাদনে সাহায্য করে। সম্পদ-সৃষ্টিতে জমির ভূমিকা অপরিসীম, তবে সমস্ত জমিই সম্পদ-সৃষ্টিতে সমান ভূমিকা পালন করে না। মরু অঞ্চল জলাভাবে কৃষিকার্যের অযোগ্য, আবার মেরু অঞ্চলে অধিক শৈত্যের জন্য অধিকাংশ জমিতে কৃষিকার্য হয় না, অর্থাৎ, সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে না। অতএব, পৃথিবী পৃষ্ঠের সমস্ত জমি মানুষের বিশেষ কাজে লাগে না। যেসব জমি মানুষের কাজে লাগে এবং যেসব জমি থেকে মানুষ সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে, সেইসব জমিকে কার্যকর জমি বলে।
জমি থেকে মানুষ কেবলমাত্র বনজ সম্পদ আহরণ বা কৃষিজ সম্পদ উৎপাদন করে না, ভূগর্ভ থেকে খনিজ সম্পদও উত্তোলন করে। জমি বলতে এখানে জমির আয়তন, উর্বরাশক্তি, ভূগর্ভের খনিজ দ্রব্য, জমির উপরিভাগের বাতাস, সূর্যকিরণ, ভূগর্ভের ও ভূপৃষ্ঠের জল প্রভৃতি ত্রিমাত্রিক পরিস্থিতি বা অবস্থানকে বোঝায়। আবার মানুষ বলতে এখানে মানুষের কর্মদক্ষতা, জ্ঞান, বুদ্ধি, কৌশল ও সংগঠন প্রভৃতি সাংস্কৃতিক গুণাবলিকে বোঝায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের মোট জমির পরিমাণ 32 লক্ষ 87 হাজার 782 বর্গ-কিলোমিটার (পাক অধিকৃত কাশ্মীর সহ। কিন্তু কার্যকর জমির পরিমাণ মাত্র 28 লক্ষ বর্গ-কিলোমিটার। পাক অধিকৃত অঞ্চল ব্যতীত ভারতের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ-কিলোমিটারে 382 জন, কিন্তু মানুষ-জমির অনুপাত প্রায় 432 জন প্রতি বর্গ-কিলোমিটারে। 2010 সালে মিশরের জনঘনত্ব ছিল মাত্র 83 জন প্রতি বর্গ-কিলোমিটারে। কিন্তু নীল নদের সংকীর্ণ উপত্যকা ও মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত কয়েকটি মরূদ্যান ছাড়া মিশরের অধিকাংশ অঞ্চলই মনুষ্য বাসের অনুপযুক্ত। তাই, মিশরের কার্যকর জমির পরিমাণ মাত্র 34,815 বর্গ-কিলোমিটার। ওই সময় মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র 8.45 কোটি। সুতরাং, মিশরের মানুষ ও জমির অনুপাত হয় 2427 জন প্রতি বর্গ-কিমিতে।
যতদিন পর্যন্ত মানুষের ভূমি সম্পর্কে দ্বিমাত্রিক ধারণা ছিল, ততদিন পর্যন্ত মানুষ সম্পদ সংগ্রহ করত ভূমির উপরিভাগ থেকে। বর্তমানে মানুষ ভূমির অভ্যন্তর থেকে খনিজ সম্পদ উত্তোলন করে জমির কার্যকর শক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। তাই মানুষ-জমি অনুপাত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভূমির অভ্যন্তরীণ (Internal) ও বাহ্যিক বহনক্ষমতা (External Carrying Capacity) এবং মানুষের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন—এই তিনটি বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
➋ মানুষ-জমি অনুপাতের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Man - Land Ratio) : মানুষ-জমি অনুপাতের বৈশিষ্ট্যগুলি হল— (1) মানুষ-জমি অনুপাতে মানুষের সঙ্গে জমির একটা গুণগত সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়। পরিমাণগত পরিমাপে এই সূচক অক্ষম। (2) মানুষ-জমি অনুপাত থেকে দেশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার নিখুঁত কোনো চিত্র না পাওয়া গেলেও দেশের জনাধিক্য বা জনবিরলতা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। (3) এই অনুপাত থেকে দেশের কাম্য জনসংখ্যা সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। (4) এই অনুপাত থেকে কার্যকর জমির উপর জনসংখ্যার চাপ নির্ণয় করা যায়। (5) মানুষ-জমি অনুপাত নির্ণয় অত্যন্ত কঠিন কাজ। কারণ, জমির কার্যকর শক্তি সব সময় পরিবর্তনশীল। কৃষিপ্রধান দেশের ক্ষেত্রে এই পরিমাপ সম্ভব হলেও শিল্পপ্রধান ও খনিজে সমৃদ্ধ দেশগুলির ক্ষেত্রে মানুষ-জমি অনুপাত নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। মানুষ-জমি অনুপাতের ব্যবহারিক গুরুত্ব খুব কম।
➌ মানুষ-জমি অনুপাতের গতিশীল প্রকৃতি (Dynamic Nature of Man - Land Ratio) : জমির কার্যকারিতা গতিশীল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে জমির কার্যকারিতাও পরিবর্তিত হচ্ছে। যেসব জমি আজ সম্পদ-সৃষ্টিতে অক্ষম, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে সম্পদ-সৃষ্টিতে তা সক্ষম হবে। পূর্বে মানুষ কেবলমাত্র ভূমির উপরিভাগ থেকেই বনজ ও কৃষিজ দ্রব্য সংগ্রহ করত। কিন্তু বর্তমানে মানুষ ভূমির অভ্যন্তরভাগ থেকেও খনিজ সম্পদ সংগ্রহ করছে। ফলে জমির কার্যকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অতএব সহজেই অনুমান করা যায় যে, জমির কার্যকরিতা স্থিতিশীল নয় বরং গতিশীল। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার আরো উন্নতি হলে জমির বহন ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। মানুষ-জমি অনুপাত আরও গতিশীল হয়ে উঠবে। মানুষ-জমি অনুপাতের পরিবর্তন হলে মানুষের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপেরও গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। কোনো দেশের জমির বহন ক্ষমতার তুলনায় জনসংখ্যা কম হলে মানুষের অর্থনৈতিক কাজকর্মের সুযোগ বাড়ে। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও সেবাক্ষেত্রে কাজের সুযোগ বাড়ে ও বৃত্তি সম্প্রসারিত হয়।
➍ মানুষ-জমি অনুপাতের প্রভাব (Influence of Man-Land Ratio) : মানুষ-জমি অনুপাতের প্রভাব নিম্নরূপ— [1] জনসংখ্যার বিভাজন ও স্থিতিশীলতার উপর মানুষ-জমি অনুপাতের প্রভাব : কোনো দেশের মানুষ-জমি অনুপাত বেশি হলে জীবনধারণের জন্য মানুষ কার্যকর জমির সন্ধানে সেই স্থান ত্যাগ করে; প্রয়োজনে বিদেশে পাড়ি দেয়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে লোকবসতির তুলনায় কার্যকর জমির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। তাই, ইউরোপের ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ থেকে দলে দলে লোক এসে এইসব দেশগুলিতে বসতি স্থাপন করেছে। [2] কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদনের উপর মানুষ-জমি অনুপাতের প্রভাব : কোনো দেশের মানুষ-জমি অনুপাত যদি কম হয়, অর্থাৎ, মোট জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে সেইসব দেশে ব্যাপক কৃষি-পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ হয়। এই কৃষি-ব্যবস্থায় উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দ্রব্য প্রয়োগ করে ও উন্নত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চাষ-আবাদ করা হয় বলে মাথাপিছু কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া ও সি.আই.এস-ভুক্ত দেশগুলিতে মানুষ-জমি অনুপাত কম। তাই, এই অঞ্চলে ব্যাপক কৃষি-ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অন্যদিকে যে-সমস্ত দেশে মানুষ-জমি অনুপাত বেশি, অর্থাৎ, জমির তুলনায় মানুষের সংখ্যা বেশি, সেখানে অল্প জমিতে প্রচুর শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করে প্রগাঢ় কৃষি পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা হয়। এই পদ্ধতিতে জলসেচ, সার, কীটনাশক ওষুধ ও উচ্চ ফলনশীল বীজ বেশি মাত্রায় প্রয়োগ করে ভারত, চিন ও জাপানে প্রচুর পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা হয়। পতিত জমি ও চাষযোগ্য অনাবাদি জমি পুনরুদ্ধার করে এই পদ্ধতিতে কৃষিজ ফসলের উৎপাদন ও বহুফসলি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া ও নির্দিষ্ট কার্যকর জমির উপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বাড়ে। ফলে, উৎপাদন-ব্যবস্থায় ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি (Law of Diminishing Return) কার্যকর হয়। উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণের মাত্রা বৃদ্ধি করলেও উৎপাদন সমহারে বৃদ্ধি পায় না। ফলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কৃষিতে ছদ্ম-বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। রপ্তানি-যোগ্য কৃষি—আমদানি-নির্ভর কৃষিতে রূপান্তরিত হয়। অতএব বলা যায়, মানুষ-জমি অনুপাতের পরিবর্তন ঘটলে মানুষের স্থায়িত্ব ও অর্থনৈতিক কাজকর্মের গতি-প্রকৃতির উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
➎ জন ঘনত্ব (Density of Population) : কোন দেশ বা অঞ্চলের জনসংখ্যার বণ্টনের তারতম্যের সূচক হল জন ঘনত্ব। কোনো দেশ বা অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ও মোট জমির পরিমাণ বা ক্ষেত্রমানের অনুপাতকে জন ঘনত্ব বলে। অর্থাৎ কোনো দেশ বা অঞ্চলের মোট জনসংখ্যাকে ঐ দেশ বা অঞ্চলের মোট ক্ষেত্রফল দিয়ে ভাগ করলে জনঘনত্ব পাওয়া যায়। জন ঘনত্ব হল— মানুষ ও জমির পরিমাণগত সম্পর্ক। জন ঘনত্ব সর্বদা পূর্ণমানে প্রকাশ করা হয়। সূত্র অনুসারে—
2011 খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যা ছিল 121 কোটি 1 লক্ষ 93 হাজার 422 জন এবং ভারতের ক্ষেত্রমান (31 লক্ষ 66 হাজার 414 বর্গ-কিলোমিটার।) পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ক্ষেত্রমান ব্যতীত। ভারতের ক্ষেত্রমান হল 31,66,414 বর্গকিমি।➏ জন ঘনত্বের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Population Density) : জন ঘনত্বের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল- (1) জন ঘনত্ব হল- মানুষ জমির (কার্যকরী ও অকার্যকরী) একটি পরিমাণগত সম্পর্ক। (2) জন ঘনত্ব থেকে কোনো দেশের জনসংখ্যা বণ্টনের প্রকৃতি সম্পর্কে সহজে ধারণা লাভ করলেও মোট জনসংখ্যা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা লাভ করা যায় না। 2010 খ্রিস্টাব্দে প্রতি বর্গ-কিলোমিটারে চিনে বাস করত 128 জন, যা ভারতের জন ঘনত্বের তুলনায় অনেক কম। অথচ চিন পৃথিবীর বৃহত্তম জনবহুল দেশ (জনসংখ্যা- প্রায় 134.1 কোটি)। (3) জন ঘনত্ব থেকে কোনো দেশের কাম্য জনসংখ্যা (Optimum Population) সম্বন্ধে কোনো ধারণা করা যায় না। (4) জন ঘনত্ব থেকে কোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা লাভ করা যায় না। ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, জার্মানি প্রভৃতি বেশি জন ঘনত্বযুক্ত দেশের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় 3,550 ডলার থেকে 6451 ডলার। কিন্তু ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ প্রভৃতি বেশি-জন ঘনত্বযুক্ত অঞ্চলে মাথাপিছু বাৎসরিক আয় মাত্র 85 ডলার থেকে 215 ডলার।
➐ জন ঘনত্ব ও মানুষ-জমি অনুপাতের মধ্যে পার্থক্য :
বিষয় | জন ঘনত্ব | মানুষ-জমি অনুপাত |
---|---|---|
1.পরিমাপের প্রকৃতি | জন ঘনত্ব, মোট জনসংখ্যা ও মোট জমির অনুপাত একটি পরিমাণগত সম্পর্ক। | মানুষ-জমি অনুপাত একটি গুনগত সম্পর্ক। |
2.পরিমাপের উপাদান | জন ঘনত্ব নির্ণয়ে কেবলমাত্র মোট জমির পরিমাণকে বিবেচনা করা হয়। জমির কার্যকারিতা সম্পর্কে কোনো হিসাব এর অন্তর্ভুক্ত হয় না। | মানুষ-জমি অনুপাতের ক্ষেত্রে কেবল মাত্র কার্যকর জমির পরিমাণ বিবেচনা করা হয়। যে জমি ব্যবহারের অযোগ্য, তা হিসাবের মধ্যে ধরা হয় না৷ |
3.জীবনযাত্রার মানের আভাস | জন ঘনত্ব থেকে কোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যেমন কোনো সার্বিক পরিচয় পাওয়া যায় না, তেমনি ওই দেশের বা অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কেও কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। | মানুষ-জমি অনুপাত থেকে কোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে যেমন সঠিক ধারণা পাওয়া যায় তেমনি এর দ্বারা মানুষের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কেও একটি ধারণা লাভ করা যায়। |
4.কাম্য জনসংখ্যার ধারণা | জনঘনত্ব পরিমাপ করে কাম্য জনসংখ্যা সম্পর্কে কোনো ধারণা লাভ করা যায় না৷ | মানুষ-জমি অনুপাত থেকে কাম্য জনসংখ্যা সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা যায়। |
5.জনসংখ্যা বণ্টনের প্রকৃতি | জনসংখ্যার ঘনত্ব থেকে কোনো দেশের মোট জনসংখ্যা সম্পর্কে কোনো ধারণা লাভ না হলেও জনসংখ্যা বণ্টনের প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। | মানুষ-জমি অনুপাত থেকে জনসংখ্যা কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের কারণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যেতে পারে এবং এ-থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নেওয়া যেতে পারে। |
২. পৃথিবীর জনসংখ্যার বণ্টন (World Distribution of Population) : 2010 খ্রিস্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী (UN) সারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল 690.87 কোটি। তবে, এই জনসংখ্যা পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে বণ্টিত নয়। কোনো কোনো অঞ্চল অত্যন্ত জনবহুল, আবার কোনো কোনো অঞ্চল জনমানবশূন্য। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় 90 শতাংশ জনগণ বাস করে স্থলভাগের মাত্র 10 শতাংশ অঞ্চলে। আর, 10 শতাংশ মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর মোট স্থলভাগের 90 শতাংশ অঞ্চলে। 2050 সালে এই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় 890 কোটি।
➊ বিশ্বের জনসংখ্যা বণ্টনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য : (1) 81.6 শতাংশ মানুষ স্বল্পোন্নত অঞ্চল বা দেশে বসবাস করে (2) 11.8 শতাংশ মানুষ অনুন্নত অঞ্চল বা দেশে বাস করে। (3) অবশিষ্ট 6.6 শতাংশ মানুষ উন্নত দেশগুলিতে বাস করে। (4) এশিয়া হল পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা জনবহুল মহাদেশ। 60.31 শতাংশ বা তিন পঞ্চমাংশ মানুষের বাস এই মহাদেশে (5) দ্বিতীয় জনবহুল মহাদেশ হল আফ্রিকা (14.95%) এরপরে রয়েছে ইউরোপ (10.61%) (6) জনবিরল মহাদেশ হল ওশিয়ানিয়া (0.52%) (7) বিশ্বের জনবহুল দেশ হল চিন (134.1 কোটি), দ্বিতীয় ভারত, (121.0 কোটি), তৃতীয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র (30.87 কোটি) (8) ইউরোপের জনবহুল দেশ হল জামানি (8.2 কোটি) (9) ইথিওপিয়া (8.5 কোটি) ও মিশর (8.45 কোটি) আফ্রিকার জনবহুল দেশ। (10) দক্ষিণ আমেরিকার জনবহুল দেশ ব্রাজিল (19.07 কোটি) (11) ওশিয়ানিয়া মহাদেশের জনবহুল দেশ অস্ট্রেলিয়া (2.2 কোটি) (12) অনুন্নত দেশগুলির জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান ও উন্নত দেশগুলির জনসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। (13) মানুষের গড়পড়তা আয়ু জাপানে বেশি 83.2 বছর, আফগানিস্তানে কম, 44.6 বছর। (14) শিশু জন্মের হার এশিয়াতে সবচেয়ে বেশি (57%) ওশিয়ানায় সবচেয়ে কম (1%)।
৩. পৃথিবীতে অসম জনসংখ্যা বণ্টনের কারণসমূহ (Causes of Uneven Distribution of World Population) : বসবাসের উপযোগী অনুকূল পরিবেশের তারতম্যের জন্য পৃথিবীর সর্বত্র জনসংখ্যার বণ্টন তথা জনঘনত্ব সমান নয়। যেসব কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে অসম জনবণ্টন দেখা যায় তাদের প্রধানত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় (ক) প্রাকৃতিক কারণসমূহ এবং (খ) অ-প্রাকৃতিক কারণসমূহ।
(ক) প্রাকৃতিক কারণসমূহ (Physical Factors) : জনসংখ্যা বণ্টনে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের প্রভাব নীচে আলোচনা করা হল—
[1] অক্ষাংশগত অবস্থান : দেশ বা মহাদেশের অবস্থান— ওই দেশ বা অঞ্চলের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে। উচ্চ অক্ষাংশে অবস্থিত স্থানগুলি অত্যধিক শৈত্যের জন্য প্রায় উদ্ভিদ-বর্জিত এবং কৃষিকাজের অযোগ্য। তাই, জনসংখ্যার ঘনত্বও কম। মধ্য অক্ষাংশের স্থানগুলিতে জলবায়ু নীতিশীতোষ্ম প্রকৃতির। তাই, এই অঞ্চল চাষবাস, পশুপালন, ব্যাবসা-বাণিজ্য প্রভৃতিতে যথেষ্ট উন্নত। ফলে, এই অংশে জনঘনত্ব বেশি। ক্রান্তীয় উষ্ণ-আর্দ্র অঞ্চলে (নিরক্ষরেখা ব্যতিরেকে) জলবায়ু ছাড়া অন্যান্য প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ বেশি জনঘনত্বের জন্য দায়ী।
[2] ভূ-প্রকৃতি : জনসংখ্যা বণ্টনের উপর ভূ-প্রকৃতির প্রভাব সর্বাধিক। উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে বা মালভূমি অঞ্চলে ভূ-প্রকৃতি বন্ধুর হওয়ায় মানুষের জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা কম। তাই, পার্বত্য অঞ্চলে এবং মালভূমি অঞ্চলে জনবসতি কম। পার্বত্য অঞ্চলে কৃষিকাজের উপযোগী উর্বর সমতল ভূমির অভাব, রাস্তাঘাট নির্মাণ ব্যয়সাপেক্ষ, ভারী শিল্প গড়ে ওঠার পক্ষে প্রতিকূল, ভূমি ধস এই অঞ্চলের মানুষের চিরসাথী, ফলে মানুষের জীবনধারণের উপযুক্ত পরিবেশ না গড়ে ওঠায় এই অংশে মানুষের বসবাস খুবই কম । তবে, পার্বত্য অঞ্চল অপেক্ষা মালভূমি অঞ্চলের জনঘনত্ব সামান্য বেশি। সমভূমি অঞ্চলের বিস্তীর্ণ উর্বর সমতল ক্ষেত্র, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা—কৃষিকাজ গড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই, এই অঞ্চলে জন সংখ্যার ঘন বণ্টন দেখা যায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দক্ষিণাত্যের মালভূমি ও হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল অপেক্ষা গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি।
[3] জলবায়ু : জনসংখ্যা বণ্টনে জলবায়ুর ভূমিকা অপরিসীম। জলবায়ু পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, কৃষিকাজ, শিল্পোৎপাদন প্রভৃতি ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। উষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের মানুষের বেশভুষা, খাদ্য-উৎপাদন ও খাদ্যাভ্যাস, কৃষিজ দ্রব্যের উৎপাদন ও উৎপাদন ব্যবস্থা - নাতিশীতোষ্ম অঞ্চলের থেকে ভিন্ন হওয়ার কারণ হিসাবে জলবায়ুর পার্থক্যকে দায়ী করা হয়। পৃথিবীর যে-সকল অঞ্চলের জলবায়ু কৃষিজ ফসল উৎপাদনের উপযোগী, সেসব অঞ্চলে জন বণ্টনের আধিক্য লক্ষ করা যায়। উচ্চ অক্ষাংশ অসহনীয় শৈত্যের কারণে, নিরক্ষীয় অঞ্চল অস্বাস্থ্যকর উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুর জন্য এবং শীতল ও উষ্ণ মরু অঞ্চল অতি শুষ্ক জলবায়ুর জন্য মনুষ্যবাসের অনুপযোগী। তাই, এই অঞ্চলে জন ঘনত্ব কম। অস্বাস্থ্যকর উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুর জন্য দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন, আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকা এবং শুষ্ক-উষ্ণ জলবায়ুর জন্য আফ্রিকার সাহারা, দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা, ভারতের থর মরুভূমি অথবা চিরতুষারাবৃত মেরু অঞ্চল বা হিমশীতল পার্বত্য অঞ্চলে অসহনীয় জলবায়ুর জন্য মানুষের বসবাস খুবই কম।
[4] শিলা ও মৃত্তিকা : জনসংখ্যার ঘনত্ব-নির্ধারণে শিলা ও মৃত্তিকার প্রভাব অগ্রগণ্য। ভূপৃষ্ঠে বা ভূ-অভ্যন্তরে জলের সহজলভ্যতা নির্ভর করে ভূপৃষ্ঠের শিলার প্রকৃতির উপর। বেলেপাথর বা চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে শিলার প্রবেশ্যতা বেশি হওয়ায় জল সহজেই ভূ-অভ্যন্তরে চলে যায়। জলের অভাবে যেমন চাষবাস হয় না, তেমনি এই অঞ্চলে বসতিও গড়ে ওঠে না। আবার প্রবেশ্য শিলাস্তরে নীচে অপ্রবেশ্য শিলাস্তর অবস্থান করলে ভূগর্ভে জলের সঞ্জয় ঘটে। ফলে, পানীয় জলের জোগান ও কৃষিক্ষেত্রে জল-সরবরাহ অক্ষুণ্ণ থাকে। জলের প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে জনবসতি বিস্তার লাভ করে। উর্বর পলি মৃত্তিকায় গাছের সবরকম খাদ্যমৌল উপস্থিত থাকে। তাই, এই মৃত্তিকা কৃষিকাজের উপযোগী। আবার আম্লিক ল্যাটেরাইট মৃত্তিকায় উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম খাদ্যমৌল গ্রহণযোগ্য অবস্থায় পাওয়া যায় না। তাই, এই মৃত্তিকা কৃষিকাজের উপযোগী নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পলিমৃত্তিকা-সমৃদ্ধ গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল কৃষিকাজের উপযোগী হওয়ায় এই অঞ্চলে জনাধিক্য ঘটেছে। ভারতের মালভূমি অঞ্চলের ল্যাটেরাইট-সমৃদ্ধ অনুর্বর মৃত্তিকায় চাষবাস তেমনভাবে গড়ে না ওঠায় জনাধিক্য তেমন ঘটেনি।
[5] জলের প্রাপ্যতা : কোনো অঞ্চলের চাষবাসের উন্নতি যেমন নির্ভর করে জলের প্রাপ্যতার উপর, তেমনি জনবিন্যাস ও ঘনত্ব নির্ভর করে কৃষির উন্নতি ও পানীয় জলের প্রাপ্যতার উপর। পৃথিবীর জন বিন্যাস লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ জনবসতি পানীয় জলের উৎসকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। জলের অভাব ও আধিক্য—কোনোটাই জন বিন্যাসের অনুকূল অবস্থা নয়। জলাধিক্যের কারণে নদীর তীরবর্তী প্লাবন ভূমিতে (জলাভূমি) এবং জলাভাবে ক্লিষ্ট মরু অঞ্চলে তেমনভাবে বসতি গড়ে উঠতে পারে না। আবার নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে (লিভি অঞ্চলে) জলের যেমন অভাব ঘটে না, তেমনি এই অঞ্চল অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় বন্যার জল প্রবেশ করতে পারে না। তাই, এই অঞ্চলগুলিতে জনঘনত্বের আধিক্য লক্ষ করা যায়।
[6] উদ্ভিদ : বনভূমির উপস্থিতিও জনঘনত্বকে প্রভাবিত করে। ইউরোপ ও কানাডার সরলবর্গীয় বনভূমির প্রান্তভাগে বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহ ও সরবরাহ করার জন্য ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বনভূমি থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহের জন্য বনভূমির প্রান্তভাগে জনবসতি গড়ে উঠেছে। আবার কঙ্গো ও আমাজন অববাহিকায় ঘন অরণ্য সৃষ্টি হওয়ায় এখানে জনসংখ্যা অতি বিরল।
[7] খনিজ সম্পদের প্রাপ্তি : খনিজ সম্পদের বণ্টন জনসংখ্যার বণ্টনকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। উষ্ম মরু অঞ্চল ও বন্ধুর মালভূমি অঞ্চলে জনবসতির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হলেও কোনো কোনো স্থানে খনিজ দ্রব্যের উপস্থিতির জন্য ঘন জনবসতি গড়ে ওঠে। অরণ্যে ঢাকা বন্ধুর মালভূমি অঞ্চলের কিরিবুরু, মেঘাতুবুরু ও বোলানিতে লৌহখনিগুলিকে কেন্দ্র করে ঘন বসতি গড়ে উঠেছে। মধ্য প্রাচ্যের মরুপ্রায় অঞ্চলগুলিতে খনিজ তেলের অবস্থানের জন্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা মরুভূমিতে নাইট্রেট খনির অবস্থানের জন্য ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চলে সোনার খনিকে কেন্দ্র করে কালগুলি ও কুলগার্ডি শহর গড়ে উঠেছে।
[খ] অ-প্রাকৃতিক কারণসমূহ (Non- physical Factors) : প্রাকৃতিক কারণসমূহের মতো অ-প্রাকৃতিক কারণসমূহ ও জনবণ্টনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। যে সমস্ত অ-প্রাকৃতিক কারণসমূহ জনসংখ্যার বণ্টনের উপর প্রভাব বিস্তার করে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল—(1) অর্থনৈতিক পরিবেশ, (2) সামাজিক পরিবেশ এবং (3) রাজনৈতিক পরিবেশ।
[1] অর্থনৈতিক পরিবেশ : দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জনসংখ্যার ঘনত্বকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নির্ভর করে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির উপর। অর্থনৈতিক দিক থেকে অনুন্নত অঞ্চলগুলিতে সম্পদের প্রাচুর্য না থাকায় জনবসতির অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় না। ফলে, এই অঞ্চলে জন ঘনত্ব কম হয়। অপরদিকে, অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বচ্ছল দেশগুলিতে জন ঘনত্ব বেশি। উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে বিশেষ উন্নত। তাই, এই সকল অঞ্চলে জন ঘনত্ব বেশি। পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলিতে কাজের সুযোগ বেশি থাকার জন্য বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিতে জন ঘনত্ব বেশি। নিউ ইয়র্ক, টোকিও, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, কলকাতা ও মুম্বাই প্রভৃতি বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলিতে জনঘনত্ব বেশি।
[2] সামাজিক পরিবেশ : সামাজিক পরিবেশের উপরেও জন ঘনত্ব নির্ভর করে। সামাজিক পরিবেশের প্রভাবক গুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা—(i) ধর্মীয় প্রভাব ও (ii) সাংস্কৃতিক প্রভাব।
(i) ধর্মীয় প্রভাব : ধর্মীয় কারণে পৃথিবীর নানা স্থানে ছোটো-বড়ো অনেক শহর গড়ে উঠেছে। এই সকল স্থানে বহিরাগতদের আগমনের ফলে জনঘনত্ব ক্রমশ বাড়ছে। আরবের মক্কা, ভারতের হরিদ্বার, বারাণসী, পুরী প্রভৃতি ধর্মীয় শহরগুলিতে জনসংখ্যার চাপ বেশি।
(ii) সাংস্কৃতিক প্রভাব : সাংস্কৃতিক পরিবেশের উন্নতিও জনসংখ্যার পুনর্বিন্যাসে সাহায্য করে। মানুষের শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি হলে কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি হয়। উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, ব্যবহার এবং নতুন নতুন সম্পদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ফলে, জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। পৃথিবীর বহু অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও উন্নত সংস্কৃতির অভাবে তা ব্যবহারযোগ্য সম্পদে উন্নতি করা সম্ভব হয়নি। ফলে, ওই অঞ্চলগুলিতে জনবসতিও তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগ করে মানুষ ঊষর মরুভূমিতে জলসেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন করে ফসল উৎপাদন করছে। হিমশীতল তুন্দ্ৰা অঞ্চলে যেখানে প্রয়োজনীয় উষ্ণতার অভাবে চাষবাস করা সম্ভব নয়, গবেষণাগারে বীজের অঙ্কুরোদ্গম (Vernalisation) করে, সেসব অঞ্চলে অল্প সময়ের মধ্যে ফসল উৎপন্ন করা হচ্ছে। সংস্কৃতির উন্নতির ফলে মানুষ আজ জনবিরল অঞ্চলেও জনপদ দেখা যাচ্ছে।
[3] রাজনৈতিক প্রভাব : রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্যও জনসংখ্যার বণ্টন পদ্ধতির পরিবর্তন হয়। 1947 সালের 15 আগস্ট ভারত ভাগের সময় ও পরবর্তীকালে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দলে দলে শরণার্থী ভারতে আসার ফলে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের জনসংখ্যা দ্রুত হারে বেড়ে গেছে। বহু দেশের সরকার তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা বণ্টনের প্রকৃতি কোনো একটি নিয়ন্ত্রক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। বরং, কোনো দেশের বা অঞ্চলের জনসংখ্যার বণ্টন প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তাগুলির মিথস্ক্রিয়ার ফলেই নির্ণীত হয়।
৪. পৃথিবীর জনসংখ্যার আঞ্চলিক বণ্টন (Regional Distribution of World Population) : সমগ্র পৃথিবী 690.87 কোটি মানুষের বাসভূমি (2010 খ্রিস্টাব্দে হিসাব অনুযায়ী)। তবে এদের বণ্টন সর্বত্র সমান নয়। কোনো কোনো অঞ্চল জনাধিক্যে পীড়িত, আবার কোনো কোনো অঞ্চল জনমানবশূন্য। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস করে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নদীগঠিত সমভূমি অঞ্চলে। অথচ, আফ্রিকার মতো বিশাল মহাদেশে, যেখানে পৃথিবীর মোট স্থলভাগের প্রায় 24 শতাংশ বিস্তৃত, সেখানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র 14.95 শতাংশ বণ্টিত। জনসংখ্যা বণ্টনের প্রকৃতিগত পার্থক্যের উপর নির্ভর করে সমগ্র পৃথিবীকে মোট পাঁচটি ভিন্ন জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চলে ভাগ করা যায়। যথা—
জনঘনত্ব অঞ্চল | জন ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমিতে) |
(ক) অতি-নিবিড় ঘনত্বযুক্ত অঞ্চল | 100 জনের বেশি। |
(খ) নিবিড় ঘনত্বযুক্ত অঞ্চল | 51 - 100 জন। |
(গ) মধ্যম বা নাতি-নিবিড় ঘনত্বযুক্ত অঞ্চল | 11-50 জন। |
(ঘ) বিরল ঘনত্বযুক্ত অঞ্চল | 1-10 জন। |
(ঙ) অতি-বিরল ঘনত্বযুক্ত অঞ্চল | 1 জনের কম। |
৫. পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি (Trend of Growth of World Population) : কোনো বছরে কোনো দেশ বা অঞ্চলের মোট জন্ম ও মোট মৃত্যুর পরিমাণের পার্থক্যকে ঐ অঞ্চলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ধরা হয়। আবার ঐ অঞ্চলের জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির সাথে অভিবাসন যুক্ত হয়ে এবং প্রবাসন বিযুক্ত হয়ে যে পরিমাণ জনসংখ্যা পাওয়া যায়। সেই পরিমাণ জনসংখ্যাকে জনসংখ্যার বৃদ্ধি বলে। অর্থাৎ, জনসংখ্যার বৃদ্ধি = (জন্ম-মৃত্যু) + পরিব্রাজন। মানুষের প্রজনন ক্ষমতার তারতম্য, চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ; সম্পদ উৎপাদনের তারতম্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রভৃতি কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তারতম্য ঘটে।
পৃথিবীতে মানুষের প্রথম আবির্ভাব 10 থেকে 20 লক্ষ বছর আগে। খ্রিস্টের জন্মের সময় পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়ায় 25 কোটি। এই জনসংখ্যা দ্বিগুণ হতে সময় লাগে প্রায় 1000 বছর। আবার 1650 খ্রিস্টাব্দ থেকে 2010 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র 360 বছরে জনসংখ্যা প্রায় 54.5 কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় 690.87 কোটি, অর্থাৎ, 360 বছরে জনসংখ্যা বাড়ে প্রায় 636.37 কোটি বা প্রায় 11.68 গুণ। জনসংখ্যা বিদরা আশঙ্কা করছেন যে, ওই জনসংখ্যা 2050 খ্রিস্টাব্দে দাঁড়াবে 890 কোটি। জনসংখ্যার এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি জনবিস্ফোরণ (Population Explotion) নামে পরিচিত। ডঃ তারক মোহন দাস-এর মতে, পৃথিবীর জনসংখ্যা যদি বর্তমান হারে বাড়তে থাকে তবে 5000 বছর পরে মোট জনসংখ্যার ওজন পৃথিবীর ওজনের সমান হবে। তবে বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সকল সময় বর্তমান হারে বাড়েনি । কখনো বেড়েছে আবার কখনো কমেছে। বিশ্বের জনসংখ্যা-বৃদ্ধির গতি-প্রকৃতির চিত্র নীচে দেওয়া হল।
বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মূলে আছে দুটি কারণ—একটি হল শিল্পায়ন ও অন্যটি হল নগরায়ণ। প্রাচীন কৃষি-ব্যবস্থা থেকে দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে বিশ্বের জনসংখ্যার যে ধারাবাহিক বিবর্তন ঘটেছে ওয়ার্নার থম্পসন, বিজু গার্নিয়ার, হ্যাগেট প্রমুখ ভূগোলবিদগণ তার একটি মডেল বা তত্ত্ব প্রদান করেছেন।
৬. পরিব্রাজন (Migration) : স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে মানুষ যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে, তখন তাকে পরিব্রাজন বলে। এই পরিব্রাজন কোনো দেশের জনসংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির অন্যতম উপাদান। মূলতঃ মানুষের বাসস্থানের স্থান পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে পরিব্রাজন বলে। বিভিন্ন ভূগোলবিদ্ এই পরিব্রাজনকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন— ➊ লি: (E. S. Lee) প্রদত্ত সংজ্ঞা: পরিব্রাজন হলো যাত্রাপথের দূরত্ব বিচার না করে বসাসের জন্য চিরতরে বা প্রায় চিরতরে স্থান পরিবর্তন। ➋ ভৌগোলিক ট্রেওয়ার্থা-এর মতে: কোনো এলাকায় জনসংখ্যার পরিমাণগত তারতম্যের অন্যতম কারণ পরিব্রাজন। ➌ বোগ-এর মতে: পরিব্রাজন হলো এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক উপাদান যা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে প্রসারিত এবং সামাজিক অসাম্যকে দূর করে। সুতরাং বলা যায় যে, পরিব্রাজন হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। পরিব্রাজন সাধারণত এক দেশের বা রাজ্যের কিংবা ভিন্ন দেশের মধ্যে সংঘটিত হয়। পরিব্রাজনের মধ্যে যে গতিশীলতা লক্ষ করা যায় তা স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে হওয়া প্রয়োজন।
𖤂 পরিব্রাজনের কারণ : সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, বিভিন্ন কারণ পরিব্রাজনের জন্য দায়ী। মূলতঃ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি কারণের জন্য মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। এই সমস্ত কারণগুলি হলো— ① অর্থনৈতিক কারণ ② সামাজিক কারণ ③ রাজনৈতিক কারণ ④ প্রাকৃতিক কারণ ⑤ অন্যান্য কারণ।
① অর্থনৈতিক কারণ : [1] শহরে শিল্প কলকারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি থাকায় গ্রামের মানুষ শহরে বেশি চলে আসে। [2] শহরে আবার জমির দাম অত্যন্ত বেশি বলে অনেক শহরের মানুষ গ্রামে এসে সস্তায় জমি কিনে বসতবাড়ি তৈরি করে। [3] অনেকে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন এবং পৈতৃক জমি ব্যবহার করে আয় করার চেষ্টা করেন। [4] গ্রামাঞ্চলে সেবামূলক কাজের সুযোগ-সুবিধা থাকায় অনেক শহুরে অধিবাসী গ্রামে এসে বসবাস শুরু করে। [5] গ্রামের চাষিরা যে সময় কর্মহীন হয়, সেই সময় শহরে কাজের সন্ধানে চলে আসে। [6] গ্রামের মানুষ শহরের উন্নততর জীবনযাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে শহরে এসে বসবাস করতে শুরু করে। [7] এক শহর থেকে অন্য শহরে শিল্পে বিনিয়োগের অধিক সুযোগ, নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প, গাড়ি কেনার সুবিধা প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে মানুষ অন্য শহরে পাড়ি দেয়।
② সামাজিক কারণ : [1] গ্রামের মেয়ের শহরে বিবাহ হলে সে শহরে বসবাস করতে থাকে। এই পরিব্রাজন স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরনেরই হতে পারে। [2] শহরে শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির সুযোগ বেশি থাকে। তাই গ্রামের মানুষ শহরে বেশি করে চলে আসে। [3] অনেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের শেষে শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসে। [4] অনেক ব্যক্তি গ্রামাঞ্চলে বেশি প্রতিপত্তি লাভের আশায় শহর ছেড়ে গ্রামে আসে। [5] প্রভাব-প্রতিপত্তি, নাম-যশ প্রভৃতি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষ অন্য শহরে চলে যান। ডাক্তার অধ্যাপক এমনকি বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ধরণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। [6] উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য মানুষ এক শহর থেকে অন্য শহরে পাড়ি দেয়। [7] বিবাহ সূত্রে, শহরের স্ত্রীলোকগণ গ্রামে এসে বসবাস করে।
③ রাজনৈতিক কারণ : [1] প্রশাসনিক কাজে, যেমন প্রতিনিধি হিসেবে, বিধায়ক, সাংসদ প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ অনেকেই গ্রামে বসবাস করেন। এরা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসেন। [2] বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন—যুদ্ধ, রাজনৈতিক দাঙ্গা ইত্যাদি কারণে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামের শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এসে বসবাস করে। [3] অন্যান্য রাজনৈতিক কারণের মতো, দেশবিভাগও পরিব্রাজনে বাধ্য করে। যেমন—ভারত-পাকিস্তান, ভারত-বাংলাদেশ বিভাগের সময় বহু মানুষ তাদের ধর্মীয় আনুগত্যের কারণে এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে গিয়েছিলেন।
④ প্রাকৃতিক কারণ : [1] পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সমভূমিতে বাস করে। কারণ, সমভূমিতে কৃষিকাজ, রাস্তাঘাট প্রভৃতি উন্নতি ঘটে। তাই অনেক মানুষ যারা মূলতঃ পার্বত্যভূমিতে বাস করে তারা পার্বত্যভূমি ত্যাগ করে সমভূমিতে স্থানান্তরিত হয়। [2] জলবায়ু যেমন মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে, ঠিক তেমনি পরিব্রাজনের ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা পালন করে। মানুষ উষ্ণমণ্ডল ও হিমমণ্ডল অঞ্চল থেকে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে আসে বিভিন্ন সুবিধালাভের আশায়। [3] কৃষিকাজের জন্য মানুষ রুক্ষ , শুষ্ক অনুর্বর মৃত্তিকা অঞ্চল ত্যাগ করে নদী অববাহিকার উর্বর পলিমৃত্তিকা যুক্ত অঞ্চলে চলে আসে। এভাবে উর্বর মৃত্তিকা মানুষের পরিব্রাজনকে নিয়ন্ত্রিত করে। [4] আদিবাসী সম্প্রদায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বনভূমি সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করে। তারা খাদ্যের জন্য এক বনভূমি থেকে অন্য বনভূমিতে স্থানান্তরিত হয়। [5] জলভাগ ও স্থলভাগের মিলনস্থলকে উপকূল বলে। এই উপকূলীয় অংশে মানুষ মনোরম ভৌগোলিক পরিবেশ এবং মৎস্যজীবীরা মাছ ধরার জন্য অন্য জায়গা থেকে এসে বসবাস শুরু করে।
⑤ অন্যান্য কারণ : [1] শহরের অত্যধিক দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে এসে বসবাস করতে শুরু করে। [2] শহর জীবনের জটিলতা অনেক মানুষের ভালো লাগে না। তাই তারা গ্রামে চলে আস। [3] গ্রামে বন্যা, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি কারণে মানুষ অন্য গ্রামে চলে যায়। [4] বড়ো বড়ো সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন— দুর্গোৎসব, বার্ষিক ধর্মীয় মেলা প্রভৃতি উপলক্ষ্যে স্বপ্নমেয়াদি গ্রাম থেকে গ্রামে পরিব্রাজন ঘটে।
𖤂 পরিব্রাজনের শ্রেণিবিভাগ : বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিব্রাজনকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলি হলো— ① জনবসতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে ② স্থানান্তরের দিক অনুসারে ③ পরিব্রাজনের মাত্রা অনুসারে ④ পরিব্রাজনের স্থায়িত্ব অনুসারে ⑤ পরিব্রাজনের বাধ্যবাধকতার ভিত্তিতে ⑥ সাংস্কৃতিক ধরণ অনুসারে।
① জনবসতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে : [1] গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজন: বিভিন্ন কারণের জন্য মানুষ যখন গ্রাম থেকে শহরে এসে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে এসে বসবাস করতে থাকে, তখন তাকে গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজন বলে। ভারতের প্রায় 60 শতাংশ পরিব্রাজন এই শ্রেণির পরিব্রাজন। [2] শহর থেকে গ্রামে পরিব্রাজন: শহরের মানুষ গ্রামে এসে বসবাস করতে থাকলে তাকে শহর থেকে গ্রামে পরিব্রাজন বলে। ভারতের প্রায় 10 শতাংশ পরিব্রাজন এই শ্রেণির। [3] গ্রাম থেকে গ্রামে পরিব্রাজন: এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামে গিয়ে বসবাস করলে গ্রাম থেকে গ্রামে পরিব্রাজন ঘটে। প্রধানত কৃষি অধ্যুষিত অঞ্চলে এই ধরণের পরিব্রাজন ঘটে। [4] শহর থেকে শহরে পরিব্রাজন: যে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক শহরের মানুষ অন্য শহরে গিয়ে বসবাস করেন তাকে শহর থেকে শহরে পরিব্রাজন বলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাকুরি এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত কারণে এই পরিব্রাজন ঘটে থাকে।
② স্থানান্তরের দিক অনুসারে : [1] অভিবাসন (Immigration): কোনো বিদেশি যখন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অন্য কোনো দেশে চলে আসে তখন তাকে অন্তর্মুখী পরিব্রাজন বা অভিবাসন বলে। গন্তব্য দেশে এই পরিব্রাজনের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়। [2] প্ৰবাসন (Emigration): বসবাসের উদ্দেশ্যে স্বদেশের বাস ছেড়ে কোনো মানুষ যখন অন্য কোনো দেশে চলে যায়, তখন তাকে বহির্মুখী পরিব্রাজন বা এমিগ্রেশন বলে। এই পরিবরাজনের ফলে উৎস দেশে জনসংখ্যা হ্রাস পায়।
③ পরিব্রাজনের মাত্রা অনুসারে : [1] আন্তর্জাতিক পরিব্রাজন : কর্মসংস্থান বা আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে এক দেশ বা মহাদেশ থেকে অন্য দেশে বা মহাদেশে যে দীর্ঘস্থায়ী পরিব্রাজন ঘটে তাকে আন্তর্জাতিক পরিব্রাজন বলে। যেমন—আমেরিকা থেকে চিনে পরিব্রাজন। [2] অন্তর্দেশীয় পরিব্রাজন: শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে একই দেশের মধ্যে, এক রাজ্য থেকে অন্য এক রাজ্যে যে পরিব্রাজন ঘটে, তাকে অন্তর্দেশীয় পরিব্রাজন বলে। যেমন—পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওড়িশায় পরিব্রাজন ।
④ পরিব্রাজনের স্থায়িত্ব অনুসারে : [1] দীর্ঘকালীন পরিব্রাজন: বসবাসের উদ্দেশ্যে যে পরিব্রাজন ঘটে তাকে দীর্ঘকালীন পরিব্রাজন বলে। [2] স্বল্পকালীন পরিব্রাজন: শীত বা গ্রীষ্মে ঋতু অনুসারে অস্থায়ীভাবে যে পরিব্রাজন ঘটে তাকে, স্বল্পকালীন পরিব্রাজন বলে। যেমন—লাদাখ অঞ্চলের অধিবাসীরা গ্রীষ্মকালে পশুর পাল নিয়ে পাহাড়ের উঁচু অংশে উঠে যায় এবং শীতকালে পশুর পাল নিয়ে নিম্ন উপত্যকায় নেমে আসে। [3] দৈনিক পরিব্রাজন: প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে নিত্যযাত্রীদের যে পরিব্রাজন ঘটে তাকে দৈনিক পরিব্রাজন বলে।
⑤ পরিব্রাজনের বাধ্যবাধকতার ভিত্তিতে : (1) স্বেচ্ছামূলক পরিব্রাজন: স্ব-ইচ্ছায় ব্যক্তি যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিব্রাজন করে, তখন তাকে স্বেচ্ছামূলক পরিব্রাজন বলে। মূলত: উচ্চশিক্ষালাভ, অধিক উপার্জনের সুযোগ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে এই পরিব্রাজন ঘটে। (2) বাধ্যতামূলক পরিব্রাজন: নিজ ইচ্ছের বিরুদ্ধে পরিব্রাজক যখন অন্যএ পরিব্রাজনে বাধ্য হয়, তখন তাকে বাধ্যতামূলক পরিব্রাজন হবে। মূলত: রাজনৈতিক মহামারি ইত্যাদির জন্য এটি ঘটে।
⑥ সাংস্কৃতিক ধরণ অনুসারে : (1) সামাজিক পরিব্রাজন : মূলতঃ বিবাহ, বসতি স্থাপন, উচ্চশিক্ষা ইত্যাদি সামাজিক কারণে এই পরিব্রাজন ঘটে। (2) রাজনৈতিক পরিব্রাজন : সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন অস্থিরতার কারণের জন্য এই পরিব্রাজন ঘটে।
𖤂 পরিব্রাজনের প্রভাব : [1] পরিব্রাজনের ফলে শহরে যদি অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটে তবে শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে শহরাঞ্চলে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি। [2] শহরের অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বাসস্থান সমস্যার সৃষ্টি হয়, রাস্তাঘাট ও যানবাহনের সমস্যা দেখা দেয় এবং সেই সঙ্গে পানীয় জল সরবরাহ ও নিকাশি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়। [3] পরিব্রাজনের ফলে কোথাও জনসংখ্যার হ্রাস এবং কোথাও জনসংখ্যা বণ্টনের মধ্যে একটি অভারসাম্য অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। [4] অনুন্নত গ্রাম থেকে উন্নত গ্রামে জনসংখ্যার পরিব্রাজন ঘটলে, অনুন্নত গ্রামগুলিতে জনসংখ্যার চাপ কমে। সেইসঙ্গে এই গ্রামগুলির অর্থনীতির চাপ কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। [5] যে গ্রাম থেকে মনুষ্য শক্তি অন্য গ্রামে চলে যায়, সেই গ্রামের সম্পদের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। অপরপক্ষে যে গ্রামে যাবে সেই গ্রামের সম্পদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। [6] পরিব্রাজনের ফলে গ্রামীণ সমাজ পরস্পর পরস্পরের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে এক গ্রামের সঙ্গে অন্য গ্রামের অধিবাসীদের সঙ্গে এক আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং জীবনযাত্রার মধ্যে একটি ভারসাম্য লক্ষ্য করা যায়। [7] পরিভ্রাজনের ফলে উভয় স্থানের বসবাসকারী অধিবাসী কিংবা শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমদক্ষতা, উৎপাদন ক্ষমতা, জীবিকা, শক্তি প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়। [৪] পরিব্রাজনের ফলে কম সম্পদযুক্ত অঞ্চল বা গ্রাম থেকে মনুষ্য শক্তি অধিক সুবিধা তথা সম্পদপূর্ণ গ্রামাঞ্চলে মানুষের বিচলন হয়। ফলে সম্পদের হ্রাস ঘটলে, কোনো অঞ্চলের জনসংখ্যার হ্রাস ঘটে আবার সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চলে জনসংখ্যার কেন্দ্রীভবন তথা চাপ বৃদ্ধি পায়। [9] পরিব্রাজনের ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বাড়িঘর নির্মাণের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ প্রভৃতির মধ্যে একটি পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
𖤂 পরিব্রাজন সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্ব : মানুষ এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গা কেন যেতে বাধ্য হয়, কী কারণে? যায় সে সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন মত তথা তত্ত্ব প্রকাশ করে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। এই পরিব্রাজন সম্পর্কিত কয়েকটি তত্ত্ব নিয়ে নীচে আলোচা করা হলো—
➊ লি-এর মডেল : এভারেস্ট লি পরিব্রাজন সম্পর্কে তার মতবাদ বা তত্ত্বটি প্রকাশ করেছিলেন 1965 সালে। তিনি তাঁর এই তত্ত্বে বলেছেন যে, মানুষ বসবাসের এলাকা বা উৎসস্থল ছেড়ে গন্তব্যস্থলে যায় বিভিন্ন কারণের জন্য। তিনি বলেছেন মানুষের বসবাস স্থলের যেমন কিছু ভালো-মন্দ বা আকর্ষণ-বিকর্ষণ কারণ আছে; ঠিক তেমনিই গন্তব্যস্থলেরও কিছু ভালো-মন্দ বা আকর্ষণ-বিকর্ষণ তথা বিভিন্ন অনুকূল প্রতিকূল অবস্থা আছে। পরিব্রাজকেরা ওই দুটি স্থানের ভালো-মন্দ বা আকর্ষণ-বিকর্ষণ উপাদানগুলির মধ্যে তুলনা করে বা বিচার করে অবশেষে উৎসস্থল থেকে অন্য কোনো দেশ বা গন্তব্যস্থলে যাত্রা করে। লি-এর মতে, মানুষের এই পরিব্রাজনটি তিনটি নিয়ন্ত্রক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যথা-[1] পরিব্রাজনের উৎসস্থল, [2] গন্তব্যস্থল, [3] ব্যক্তিগত ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, বাধ্যবাধকতা।
এই সমস্ত নিয়ন্ত্রক দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানুষ এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাত্রা করে এবং পরিব্রাজন ঘটায়। লি তাঁর তত্ত্বে নিজস্ব কতকগুলি মত তথা মতবাদ প্রকাশ করেছেন সেগুলি হলো- [1] লি-এর মতে, কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈচিত্রের ওপর পরিব্রাজনের আয়তন নির্ভর করে। [2] ভৌগোলিক অঞ্চলের বৈচিত্র্য যত বাড়বে পরিব্রাজনও তত বাড়বে এবং বৈচিত্র্য যত কমবে পরিব্রাজনও তত কমবে। [3] লি-এর মতে, অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশি সমৃদ্ধ বা বেশি সম্পদ অঞ্চলের মানুষের পরিব্রাজনের হার বেশি হয়। [4] লি-এর মতে, কোনো অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরও পরিব্রাজনের হার নির্ভর করে। [5] কোনো অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলে পরিব্রাজনের আয়তনও বৃদ্ধি পায়। [6] লি-এর মতে, অর্থনৈতিক মন্দার ফলে পরিব্রাজনের আয়তন হ্রাস পায়। সবশেষে লি-এর তত্ত্ব থেকে বোঝা যায় যে, মানুষ যদি তার বসবাসের এলাকায় থেকে যাওয়ার সুবিধা বেশি দেখে অন্যান্য এলাকার তুলনায় তাহলে পরিব্রাজন ঘটবে না। আর যদি গন্তব্যস্থলের সুবিধা বেশি। দেখে তাহলে মানুষ সেখানে পরিব্রাজন করবে।
➋ মহাকর্ষ মডেল : জনপ্রবাহের সঙ্গে মহাকর্ষ সূত্রের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে স্টুয়ার্ট 1929 সালে মহাকর্ষ মডেল বা গ্র্যাভিটি মডেলের অবতারণা করেছেন। মহাকর্ষ সূত্রানুসারে আমরা জানি যে, 'দুটি বস্তুকণা পরস্পরকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বলের মান বস্তু দুটির ভরের সমানুপাতিক এবং তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।” স্টুয়ার্টের মতে, মহাকর্ষের এই নিয়মটির মতো পরিব্রাজন ঘটে থাকে। স্টুয়ার্ট-এর মতে, দুটি স্থানের মধ্যে পরিব্রাজনের পরিমাণ এই দুটি স্থানের জনসংখ্যার গুণফলের আনুপাতিক এবং স্থান দুটির দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক হয়। স্টুয়ার্ট তার তত্ত্বটিকে আরও ভালোভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সূত্রের অবতারণা করেছেন সেটি হলো—
যেখানে, M1 = পরিব্রাজনের সূচক
K = অনুপাতের ধ্রুবক
P2 = দ্বিতীয় স্থানের জনসংখ্যা
P1 = প্রথম স্থানের জনসংখ্যা
d2= বসতিকেন্দ্র দুটির মধ্যে দূরত্ব
উপরিউক্ত সূত্রানুসারে বলা যায় যে, দুটি অঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব যত বৃদ্ধি পায় পরিব্রাজনে ব্যক্তির সংখ্যা ততই হ্রাস পায় এবং পরিব্রাজনের তীব্রতা কমে যায়। দুটি অঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব যত কম হবে পরিব্রাজনের ব্যক্তির সংখ্যা তত বেশি হবে। এছাড়া স্টুয়ার্ট আরও বলেছেন যে, দুটি স্থানের মধ্যে পরিব্রাজনের হার ওই স্থান দুটির দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক হয়।
সমালোচনা: স্টুয়ার্ট-এর গ্রাভিটি মডেলটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলেও পরবর্তীতে, বহু ভৌগোলিকের সমালোচনা করেছেন; যেমন— [i] পিটারসেন-এর মতে, স্টুয়ার্ট তার মডেলে পরিব্রাজনকারীদের বয়স এবং লিঙ্গ কাঠামোকে গুরুত্ব দেয়নি। [ii] হ্যারিসের মতে, মহাকর্ষ মডেলের উল্লিখিত সামাজিক সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়িত হয়নি। [iii] টেলর-এর মতে, স্টুয়ার্ট-এর মডেলটি একটি অশোধিত ভৌত বিশ্লেষণ।
𖤂 র্যাভেনস্টাইন মডেল : পরিব্রাজন সম্পর্কে 1885 র্যাভেনস্টাইন তাঁর তত্ত্বটিতে ‘Laws of Migration' বা পরিব্রাজনের নীতিগুলি ব্রিটেনের “Journal of the Statistical Society” তে প্রকাশ করেছিলেন। র্যাভেনস্টাইনের মতে, পৃথিবীর বেশিরভাগ পরিব্রাজন স্বল্প দূরত্বে সংঘটিত হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলি পরিব্রাজনের জনসংখ্যাগুলিকে ধারণ করে বা আশ্রয় দেয়। তাঁর মতে দূরত্ব যদি বৃদ্ধি পায় পরিব্রাজনে জনসংখ্যার পরিমাণ তত কমে যায়। তিনি মনে করেন একটি বিকাশশীল শহরকেন্দ্রকে নির্ভর করে গ্রামে জনসংখ্যা ওই পৌরকেন্দ্রের দিকে চলে আসে, ফলে পৌরকেন্দ্রের চারপাশে গ্রামীণ জনসংখ্যার সমাগম ঘটে। পর্যায়ক্রমে প্রত্যন্ত গ্রামের দিকেও পরিব্রাজনের ধারা এগিয়ে চলে। র্যাভেনস্টাইন যে সমস্ত নীতিগুলি তাঁর তত্ত্বে প্রকাশ করেছেন সেই নীতিগুলি নীচে দেখানো হলো—
[i] র্যাভেনস্টাইনের মতে, মানুষ পরিব্রাজনের সিদ্ধান্ত প্রথমেই নেয় না, ধাপে ধাপে সবদিক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেয়। [ii] তাঁর মতে, নগর এলাকার তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মানুষই তুলনামূলকভাবে বেশি পরিব্রাজন করে। [iii] ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বেশি বাধ্য হয় । [iv] অধিকাংশ বড়ো নগর পরিব্রাজনশীল মানুষের চাপে আকার-আয়তনে বাড়ে। [v] কৃষি এলাকা থেকে অধিকাংশ পরিব্রাজন শিল্পাঞ্চলের দিকে ঘটে থাকে। [vi] মূলতঃ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই অর্থনৈতিক কারণের জন্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাত্রা করে। [vii] কোনো স্থানে যাতায়াত তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতি হলে পরিব্রাজনের ঘটনা সেইস্থানে বেশি ঘটে। [vii] বাধ্যতামূল পরিব্রাজন ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিব্রাজনকারীরা তাদের পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যায় না এবং অধিকাংশ পরিব্রাজনকারী বয়স্ক পুরুষ মানুষ হয়। [ix] অধিকাংশ মানুষ তার বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র স্থানে চলে যেতে বাধ্য হলেও, তারা খুব বেশি দূরে যেতে চায় না। [x] কোনো দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা যদি বেশি বিস্তৃত হয়, তবে ওই দেশে পরিব্রাজন বেশি হয়।
𖤂 L-F-R মডেল : মূলত লুই, ফি, রেনিস ---এই তিনজন সমাজবিজ্ঞানী তাদের নামানুসারে পরিব্রাজনের সঙ্গে সম্পর্কিত তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। তাদের এই তত্ত্ব লুই-ফি-রেনিস মডেল বা L-F-R মডেল নামে পরিচিত। গ্রামীণ উদ্বৃত্ত শ্রমিক। কীভাবে শহরে স্থানান্তরিত হয়, তার ব্যাখ্যা এই তত্ত্বে প্রতিফলিত হয়েছে। এই মডেলে বলা হয়েছে যে, কোনো দেশের দুটি স্থানে যদি দুই ধরনের আর্থিক ব্যবস্থা প্রচলিত থাকে; অর্থাৎ একটি স্থানে জীবনধারণভিত্তিক কাজকর্মের প্রাধান্য থাকে এবং অন্য একটি স্থানে শিল্পভিত্তিক বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ প্রচলিত থাকে, তাহলে জীবনধারণভিত্তিক কাজকর্মযুক্ত স্থানে যেখানে বেশিরভাগ শ্রমিক প্রান্তিক শ্রেণির এবং অশিক্ষিত সেখান থেকে মানুষ বেশি শ্রমের মজুরির আশায় শিল্পভিত্তিক বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপযুক্ত স্থানে চলে যায়।
এই মডেল-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যেমন—ভারত, বাংলাদেশ সেখানে শ্রমিকদের প্রান্তিক উৎপাদন শূন্য এমনকি ধনাত্মকও হয়ে থাকে, সেখান থেকেই মানুশ বেশি পরিব্রাজন করে শহরগুলিতে এবং সেখানে বিভিন্ন কাজকর্মে পরিব্রাজনকারীরা যোগদান করে। এই তত্ত্বে আরও বলা হয়েছে যে, গ্রাম ও শহরের শ্রমিকের মজুরি একরকম না হওয়া পর্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজন ঘটতে থাকবে। তবে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে গ্রামীণ ক্ষেত্রে শ্রমের দক্ষতা বাড়বে এবং শহরের মজুরির সঙ্গে গ্রামীণ মজুরি সমান হবে যাকে টার্নিং পয়েন্ট বলা হয়। এই টার্নিং পয়েন্টের ফলে গ্রামের শ্রমিকগণ আর শহরমুখী হয়ে ওঠে না এবং পরিব্রাজনও করে না। যার ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে শ্রমের জোগানে ভারসাম্য তৈরি হয় এবং পরিব্রাজনের পরিমান কমে যায়।
𖤂 নরিসের মডেল : পরিব্রাজন সম্পর্কে লি-এর তত্ত্বের বিপরীত তত্ত্ব নরিস তাঁর মডেল-এ 1972 সালে তুলে ধরেছেন এবং জনসমক্ষে নিয়ে এসেছেন। নরিস-এর মতে কোনো মানুষ যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাত্রা করার চিন্তাভাবনা করে তখন তিনটি বাধার ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ এই বাধাগুলোকে বিচার বিবেচনা করে একজন পরিব্রাজনকারী পরিব্রাজন করে। বাধাগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো- [i] অচেনা এলাকায় চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন এলাকার পরিবেশ কেমন হবে সে নিয়ে চিন্তা থাকে। [ii] বাড়িঘর ছেড়ে অন্য জায়গা যেতে হলে খরচের আশঙ্কা থাকে। পরিব্রাজনের দূরত্ব যত বেশি হয়, খরচও তত বেশি হয়। [iii] বাড়িঘর ছেড়ে অন্য স্থানে যাত্রা করলে আত্মীয়-স্বজনের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নরিস-এর মতে পরিব্রাজনের উৎসস্থল ও গন্তব্যস্থলের মধ্যবর্তী শুধু বাধা নেই, সেখানে সুযোগের হাতছানিও আছে। এই সুযোগের আশায় মানুষ একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাত্রা করে। এমনকি সুযোগের তুলনামূলক বিচার করে মানুষ অনেক ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ করা গন্তব্যস্থলে না গিয়ে অন্য কোনো আরও সুবিধাজনক এলাকায় চলে যেতে চায়। এইভাবে মূলতঃ বিভিন্ন সুযোগের আশায় মানুষ একস্থান থেকে অন্যস্থানে পরিব্রাজন করে।
৭. জনসংখ্যা বিবর্তন বা পরিবর্তন তত্ত্ব বা মডেল (Demographic Transition Model) :
জনসংখ্যার বিবর্তন বা পরিবর্তন তত্ত্ব বলতে সাধারণত কোনো দেশের জনসংখ্যা পরিবর্তনের ক্রমপর্যায়কে বোঝায় যা ওই দেশের জন্ম, মৃত্যু ও প্রবজন বা পরিব্রাজনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় এবং ওই দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রতিফলনের সক্ষম। এই তত্ত্বের মূল কথা হল জনসংখ্যার ধারাবাহিক পরিবর্তন, যা কোনো দেশের জন্মহার ও মৃত্যুহার দ্বারা মূলত নির্ধারিত হয়। এই পরিবর্তন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলি নীচে আলোচনা করা হল—
(1) উচ্চ জন্মহার→ উচ্চ মৃত্যুহার = স্বল্প জনসংখ্যার বৃদ্ধি ⇆ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ⇆ দুর্বল অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থা।
(2) উচ্চ জন্মহার → নিম্ন মৃত্যুহার = জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি ⇆ শিল্পোন্নয়ন ⇆ উন্নয়নের শুরু।
(3) নিম্ন জন্মহার → নিম্ন মৃত্যুহার = জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস ⇆ আধুনিক কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতি ⇆ সবল সমাজ ও অর্থনীতি।
(4) নিম্ন জন্মহার→ অতি-নিম্ন মৃত্যুহার = জনসংখ্যার স্থিতাবস্থা ⇆ প্রয়োজনের তুলনায় জনসংখ্যা হ্রাস ⇆ সবল অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা।
ওয়ার্নার থম্পসন ও হ্যাগেট প্রমুখ ভূগোলবিদগণ জনসংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক লক্ষ করেছেন, তারই উপর ভিত্তি করে জনসংখ্যার বিবর্তন বা পরিবর্তনকে চারটি পরস্পর-সংযুক্ত পর্বে বা পর্যায়ে ভাগ করেছেন। জনসংখ্যার বিবর্তন তত্ত্বের বা মডেলের চারটি পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য নীচে আলোচনা করা হল—
(১) প্রথম পর্ব বা প্রাক্-শিল্প পর্যায় : প্রথম পর্যায় বলতে শিল্পবিল্পবের আগের সময়কে বোঝানো হয়। জনসংখ্যা বিবর্তনের প্রথম পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—(i) জন্মহার ও মৃত্যুহার উভয়ই বেশি। (ii) কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও কৃষিনির্ভর সমাজ। (ii) আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। (iv) অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার মন্থর। (v) স্বল্প জনসংখ্যা। (vi) জন্মহার মৃত্যুহার অপেক্ষা বেশি হওয়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বগামী। (vii) চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি না হওয়ায় মহামারি, দুর্ভিক্ষ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও যুদ্ধবিগ্রহের কারণে মৃত্যুহার সব সময়ই বেশি থাকত।
বয়ঃপ্রাপ্তি ও কর্মক্ষম হয়ে ওঠার আগেই অনেকের মৃত্যু ঘটত। (viii) অপুষ্টিজনিত রোগ ও দারিদ্র নিত্যসঙ্গী। উদাহরণ : বর্তমানে এই পর্যায়ের দেশ পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। তবে, আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ যেমন জাম্বিয়া, গ্যাবন, সোয়াজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশে আংশিক হলেও এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এই দেশগুলিকে প্রাক্-শিল্প পর্যায়ের দেশ বলা যায়।
(২) দ্বিতীয় পর্ব বা নবীন পাশ্চাত্য পর্যায় : শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে এই পর্যায়ের শুরু। এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—(i) অধিকাংশ ক্ষেত্রে জন্মহার অনিয়ন্ত্রিত থাকায়, এর হার উচ্চ। (ii) আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি ও চিকিৎসার সুযোগ বাড়ায় মৃত্যুহার অনেক কম হয়। (iii) জন্মহার মৃত্যুহার অপেক্ষা বেশি হওয়ায় জনসংখ্যা এই পর্যায়ে বৃদ্ধি পায়। (iv) দেশীয় বা আঞ্চলিক আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো ধীরে ধীরে মজবুত হয়। (v) অর্থনীতি প্রধানত মিশ্র প্রকৃতির। তবে সমাজ ও অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল কৃষি ব্যবস্থা। (vi) সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। (vii) শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। (viii) মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রিত কিন্তু জন্মহার অনিয়ন্ত্রিত। ফলে, জনবিস্ফোরণ ঘটতে পারে। উদাহরণ : এশিয়া মহাদেশের চিন, ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদি। ইউরোপের রোমানিয়া, ইতালি, গ্রিস প্রভৃতি দেশ এই নবীন পাশ্চাত্য পর্যায়ের দেশ। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে বর্তমানে ভারত তৃতীয় পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে।
(৩) তৃতীয় পর্ব বা নিয়ন্ত্রিত ক্রমবিবর্তিত পর্যায় বা আধুনিক পাশ্চাত্য পর্যায় : এই সময় শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। শিল্পের ওপর ভিত্তি করে অনেক শহর ও নগর গড়ে ওঠে। জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি ঘটে। এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—(i) চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি ও প্রয়োগের ফলে মৃত্যুহার অনেক কম। (ii) জন্মহার অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ধীরে ধীরে কমে আসে। (iii) শহর বা নগরকেন্দ্রিক সমাজ গুরুত্ব বা প্রাধান্য পায়। (iv) উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার চাপ ক্রমান্নয়ে কমতে থাকে। (v) উন্নত অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে ওঠে। (vi) উৎকৃষ্ট শ্রমশক্তি জীবনযাত্রার মানের বিকাশ ঘটায়। উদাহরণ : আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ এই পর্যায়ভুক্ত।
(৪) চতুর্থ পর্ব বা পরিণত পর্যায় : এই পর্যায়ে জন্মহার মৃত্যুহার অপেক্ষা কম। শিল্পের উন্নতি বা নগরের উন্নতির ফলে দেশের সর্বাধিক উন্নতি হয়। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসে। এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—(i) জন্মহার সম্পূর্ণরূপে সুনিয়ন্ত্রিত। (ii) জন্মহার ও মৃত্যুহার প্রায় সমান। (iii) কখনো কখনো জন্মহার মৃত্যুহারের চেয়ে কম। (iv) এই পর্যায়ে দেশের জনসংখ্যা স্থির থাকে, বাড়ে না। (v) অর্থনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় থাকে। (vi) এটি একটি ক্ষণস্থায়ী পর্যায়। (vii) জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। (viii) এই পর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ শিথিল করার প্রয়োজন হয়। উদাহরণ : ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ এই পর্যায়ভুক্ত। এদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অল্প বা শূন্য৷ বিজু গার্নিয়ার (Beaujeu Garnier) 1966 খ্রিস্টাব্দে জনসংখ্যা বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায় বিশ্লেষণের সময় প্রথম পর্যায়কে প্রাচীন প্রকৃতির বৃদ্ধি পর্যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় দুটিকে বিবর্তনকালীন বৃদ্ধি পর্যায় এবং চতুর্থ পর্যায়কে পরিণত বা হ্ৰাস পর্যায়—এই তিনটি ভাগে ভাগ করেন।
𖤂 কাম্য জনসংখ্যা (Optimum Population) : কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সর্বাপেক্ষা অনুকূল জনসংখ্যাই হল কাম্য জনসংখ্যা বা আদর্শ জনসংখ্যা। অন্যভাবে বলা যায় যে, কোনো দেশের প্রাপ্ত সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহারের মাধ্যমে যে পরিমাণ জনসংখ্যার জীবন যাত্রার মানের চরমতম ও সর্বাঙ্গীণ স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করা যায়, সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ জনসংখ্যাকে কাম্য জনসংখ্যা বলে। অধ্যাপক জিমারম্যান (Zimmermann)-এর মতে, মানুষ-জমি অনুপাতের আদর্শ অবস্থাকেই সাধারণভাবে কাম্য জনসংখ্যা বা আদর্শ জনসংখ্যা বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, কাম্য জনসংখ্যা হল সেই জনসংখ্যা, যার বৃদ্ধিতে ঘটে অতি-জনাকীর্ণতা (Over-Population) এবং যার হ্রাসে সৃষ্টি হয় জনস্বল্পতা (Under- Population)
𖤂 কাম্য জনসংখ্যা বৈশিষ্ট্য : কাম্য জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল— কোনো দেশের সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে অথবা কার্যকরি জমির অনুপাতে সুসামঞ্জস্যভাবে যে জনসংখ্যা গড়ে ওঠে, সেই জনসংখ্যাই হল কাম্য জনসংখ্যা। এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল - (i) জনসংখ্যা ও উৎপাদিত সম্পদের মধ্যে ভারসাম্য সূচিত করে। (ii) জনাকীর্ণতা (over population) বা জনস্বল্পতার (under population) নির্দেশক বা পরিমাপক রূপে কাজ করে। (iii) দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করে। (iv) মানব সম্পদ বা শ্রমশক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটায়। (v) মানুষ জমি অনুপাত সবচেয়ে কম হয়। (vi) কাম্য জনসংখ্যা একটি সাময়িক অবস্থা, এর স্থায়িত্ব কম, সুতরাং এটি একটি গতিশীল ধারণা।
𖤂 কাম্য জনসংখ্যার উপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান সমূহ : কোন দেশের কাম্য জনসংখ্যা ওই দেশের প্রাকৃতিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলির অবস্থার উপর নির্ভরশীল। এই তিনটি উপাদানের তারতম্যের জন্য বিভিন্ন দেশের কাম্য জনসংখ্যারও পরিবর্তন হয়। যেমন—(i) কোনো দেশের প্রাকৃতিক অবস্থা অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক উপাদানের উন্নতির অভাবে সম্পদের উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় কম হয়। স্বাভাবিকভাবে বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা কাম্য জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। (ii) কোনো দেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটলেও প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল না হওয়ায় সম্পদের উৎপাদন আশানুরূপ হয় না। ফলে, কাম্য জনসংখ্যা কম হয়। যেমন—ইজরায়েল। (iii) আবার কোনো কোনো দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল হলেও জনসংখ্যার স্বল্পতাহেতু সম্পদ উন্নয়ন ব্যাহত হয়। ফলে, দেশের কাম্য জনসংখ্যা কম হয়। যেমন—কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। (iv) গ্রিনল্যান্ড স্বল্প জনসংখ্যার দেশ, জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদের পরিমাণ আরো কম। তাই, মানুষ-জমি অনুপাত বিচারে কাম্য জনসংখ্যা অপেক্ষা স্বাভাবিক জনসংখ্যা বেশি।
𖤂 জনস্বল্পতা : প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা কম হলে তাকে জনস্বল্পতা বলে। সম্পদ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয় মনুষ্য শক্তি। এই অবস্থায় মনুষ্য শক্তি ও শ্রমের অভাব ঘটে। ফলে, সম্পদ উৎপাদন ব্যাহত হয়। জনপ্রতি সম্পদ উৎপাদন কম হয় এবং জীবনযাত্রার মানেরও তেমন আশানুরূপ উন্নতি ঘটে না। দুর্গম পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলে বা গভীর অরণ্য অঞ্চলে, চিরতুষারাবৃত ভূখণ্ডে ও মরুভূমি অঞ্চলে জনাভাবে অতি সামান্য সম্পদ উত্তোলন করা হয়।
𖤂 জনস্বল্পতার বৈশিষ্ট্য : (i) শ্রমশক্তির অভাবে সম্পদ উৎপাদন ব্যাহত হয়। (ii) সম্পদ উৎপাদন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি খুবই মন্থর গতিতে চলে। (iii) কৃষি ও শিল্পে অনুন্নত এবং জনপ্রতি আয় কম। (iv) প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা কম। (v) জনসংখ্যা ও সম্পদ সম্পর্কিত রেখাটি স্থানু বা সামান্য ঊর্ধ্বমুখী।
𖤂 জনাকীর্ণতা : কোনো দেশের জনসংখ্যা সম্পদের তুলনায় বেশি হলে তাকে জনাকীর্ণতা বলে। কাম্য জনসংখ্যার অতিরিক্ত জনসংখ্যা – জনাকীর্ণতার অন্যতম কারণ। এই অবস্থায় কার্যকর জমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি। বর্ধিত জনসংখ্যার বাসস্থানের জন্য কৃষিজমি সংকুচিত হয়। কৃষি নির্ভর অঞ্চলগুলিতে অকৃষিজ অর্থনৈতিক কার্যকলাপ উপযুক্ত ভাবে না বাড়াতে পারলে বর্ধিত জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় না। ফলে, জনাকীর্ণতার ধারণাটি প্রকট হয়ে ওঠে। উদ্বৃত্ত শ্রমকে শক্তি সম্পদ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যায় না। তাই, কৃষিজমির উপর চাপ বেশি পড়ে। দারিদ্র্য, অসন্তোষ, অশিক্ষা ও অপরাধ-প্রবণতা অবশ্যম্ভাবী ফল।
𖤂 জনাকীর্ণতার বৈশিষ্ট্য : (i) মানুষ-জমি অনুপাত কাম্য জনসংখ্যা অপেক্ষা বেশি। (ii) শ্রমশক্তি উদ্বৃত্ত হওয়ার ফলে ছদ্ম বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। (iii) কার্যকর জমির উপর চাপ বাড়ে, অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জমির অবক্ষয়ের সম্ভাবনা থেকেই যায়। (iv) জমির বহন ক্ষমতার তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হলে বাসস্থান, পানীয় জল, পয়ঃপ্রণালীর উপর চাপ পড়ে। শিক্ষার সুযোগ কমে। ফলে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের দূষণ অনিবার্য হয়ে ওঠে। (v) জনপ্রতি সম্পদ প্রাপ্তি হ্রাস পায়। ফলে আয় কম হয় এবং জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হয়।
৮. ভারতের জনবিন্যাস ও জনঘনত্ব (Population Density of India) : পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশ [চিন প্রথম, 2010 খ্রিস্টাব্দে চিনের জনসংখ্যা 134.1 কোটি ]। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের মাত্র 2.42% ভারতের অধিকারে থাকলেও মোট জনসংখ্যার 17.5% এদেশে বাস করে। পৃথিবীর প্রতি 6 জন মানুষের মধ্যে 1 জনের সামান্য বেশি হল ভারতীয়। 2011 খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যা 121 কোটি 1 লক্ষ 93 হাজার 422 জন। 2011 খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতে জনসংখ্যার ঘনত্ব হল 382 জন প্রতি বর্গ কিমিতে। 2001 খ্রিস্টাব্দে ভারতে জনসংখ্যা ছিল প্রায় 102 কোটি 70 লক্ষ। 2001-2011 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 10 বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল 17.64%। বর্তমানে চিনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (0.53%) ভারতের তুলনায় (1.64%) অনেক কম। তাই অনুমান করা হয়েছে যে 2030 সালের মধ্যে ভারতের জনসংখ্যা চিনকে ছাড়িয়ে যাবে এবং ভারত পৃথিবীর জনসংখ্যার 17.9% অংশীদার হয়ে সর্বপেক্ষা জনবহুল দেশে পরিণত হবে। ভারতে মোট জনসংখ্যা বেশি হলেও /, ভাগ মানুষ কর্মহীন এবং প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা — 20 বৎসর বয়সের নীচে। এই বিপুল পরনির্ভর জনসংখ্যা ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রধান বাধা।
𖤂 ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও গতি-প্রকৃতি : কোনো অঞ্চলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জনসংখ্যার পরিবর্তনকেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি বলে এবং এটি শতকরা হিসাবে প্রকাশিত হয়। জনসংখ্যা বাড়লে তাকে ধনাত্মক (+ve) পরিবর্তন এবং কমলে তাকে ঋণাত্মক (-ve) পরিবর্তন বলে। বিংশ শতাব্দী (1901) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ভারতের মোট জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় 5 গুণের সামান্য বেশি। তবে বিগত শতাধিক বছরে সব সময় জনসংখ্যা একই হারে বাড়েনি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পর্যায়কে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়।
(i) 1901-1921 (নিশ্চল অবস্থা) : এই সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল অত্যন্ত শ্লথ। জন্মহার বেশি হলেও মৃত্যুহার খুব বেশি থাকায় মোট জনসংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি। মহামারি (প্লেগ, বসন্ত, কলেরা প্রভৃতি), দুর্ভিক্ষ, খরা, বন্যা প্রভৃতির প্রভাবে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ঘটায় জনসংখ্যা বাড়তে পারেনি। ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ইতিহাসে 1921 খ্রিস্টাব্দে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, এই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়।
(ii) 1921 1951 (ধীর বৃদ্ধি) : 1921 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে 1951 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জনসংখ্যা ধীর গতিতে বৃদ্ধি পায়। এই সময় জন্মহার বেশি (45/1000) কিন্তু চিকিৎসা পরিসেবার উন্নতির কারণে মৃত্যুহার ক্রমশ কমতে থাকে ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
(iii) 1951-1981 (দ্রুত বৃদ্ধি ) : 1951-এর পর থেকে 30 বছরে ভারতের জনসংখ্যা অতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময়ে জন্মহার বেশি, কিন্তু দেশের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি, পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতি কারণে মৃত্যুহার অত্যন্ত কমে যায় (11/1000)। এছাড়া জনসংখ্যা অত্যধিক দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায়। প্রকৃতপক্ষে, এই সময়েই ভারতে জন বিস্ফোরণ (Population Explosion) ঘটে।
(iv) 1981 2011 ( ক্রমহ্রাসমান বৃদ্ধি) : 1981 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতে সর্বজনীন শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে বলে জন্মহার কমতে থাকে; সেইসঙ্গে চিকিৎসা শাস্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে মৃত্যুহারও কমতে থাকে। ফলে জনসংখ্যা বাড়লেও বৃদ্ধির হার আগের দশকগুলির তুলনায় অনেকটা নিম্নমুখী।
𖤂 ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমূহ : বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি কারণে ভারতে জনসংখ্যা অতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণগুলি হল— (1) উচ্চ জন্মহার ও মৃত্যুহার হ্রাস : স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত ভারতে জন্মহার ও মৃত্যুহার উভয়ই বেশি হওয়ায় জনসংখ্যা তেমনভাবে বাড়েনি। কিন্তু স্বাধীনতার পর জন্মহার আগের মতোই থাকে। কিন্তু মৃত্যুহার কমে যাওয়ায় জনসংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায়।
𖤂 অধিক জন্মহারের কারণ : (i) স্বল্প শিক্ষার হার—ভারতবর্ষে এখনও শিক্ষার হার কম। সর্বজনীন শিক্ষা, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার প্রসার তেমনভাবে ঘটেনি। ফলে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পদ্ধতির শিক্ষাও সকলের মধ্যে আসেনি। (ii) অল্প বয়সে বিবাহ—যদিও আইন অনুযায়ী ছেলে ও মেয়ের বিয়ের বয়স 21 ও 18 নির্ধারিত হয়েছে, তবু এখনও গ্রামাঞ্চলে অল্পবয়সে বিবাহের কারণে জন্মহার বেশি। (iii) ধর্মীয় কারণ—বিশেষ বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলির বিরুদ্ধে মত থাকায় জন্মহার বাড়ছে। (iv) মেয়েদের মর্যাদা ও সামাজিক মূল্য : পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের সামাজিক মূল্য ও মর্যাদা কম থাকায় সন্তান-ধারণ বিষয়ে মেয়েদের মতামতের গুরুত্ব কম।
𖤂 মৃত্যুহার হ্রাসের কারণ : 1951 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতে আধুনিক চিকিৎসার উন্নতি, মহামারি রোধ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, দুর্ভিক্ষ, ক্ষরা, বন্যারোধ প্রভৃতি কারণে মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে।
▻ অর্থনৈতিক কারণ : (i) দারিদ্র্য – ভারতের অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। পুত্রসন্তানের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তর আশায় পরিবারের মধ্যে জনসংখ্যা বাড়ছে। (ii) কৃষিভিত্তিক সমাজ-ব্যবস্থা ও উন্নয়নশীল অর্থনীতি – ভারতের কৃষিতে বেশি সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজনের কারণে জনসংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া, উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
▻ সামাজিক কারণ : পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা এবং যৌথ পরিবার প্রথা পরোক্ষভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
এছাড়াও, বিপুল সংখ্যায় শরাণার্থী আগমন স্বাধীনতার পর দেশভাগের ফলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) থেকে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। 70-এর দশকেও বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ ভারতে প্রবেশ করে। বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতে বেআইনি অনুপ্রবেশের ফলে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতেও জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এক নজরে ভারতের জনসংখ্যা
(2011 সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)
- মোট জনসংখ্যা - 121, 01, 93,422 জন
- পুরুষ জনসংখ্যা 62.37 কোটি। নারী জনসংখ্যা 58.65 কোটি
- 2001-11 একদশকে বৃদ্ধি–18.1 কোটি
- জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (2001-11 ) - 17.64%, পশ্চিমবঙ্গ 13.93%
- গ্রামীণ জনসংখ্যা- 68.84%
- শহর জনসংখ্যা – 31.6%
- জনসংখ্যার ঘনত্ব—382 জন /বর্গ-কিমি (পাক অধিকৃত কাশ্মীর ব্যতীত)
- স্বাক্ষরতা—74.04%, পশ্চিমবঙ্গ 77.08%
- পুরুষ-মহিলা অনুপাত — প্রতি 1000 জন পুরুষে 940 জন মহিলা। ব্যতিক্রম: কেরালা, প্রতি 1000 পুরুষে মহিলা 1084 জন।
- ভারতের প্রথম চারটি জনবহুল রাজ্য – (i) উত্তর প্রদেশ, (ii) মহারাষ্ট্র, (iii) বিহার, (iv) পশ্চিমবঙ্গ।
- ভারতের সর্বাধিক জনঘনত্বপূর্ণ রাজ্য— বিহার : 1102 জন প্রতি বর্গ-কিমি। এর পর আছে পশ্চিমবঙ্গ (1029জন/বর্গকিমি) ও কেরালা (859জন/বর্গকিমি)।
- ভারতের সর্বাধিক জনবিরল রাজ্য—সিকিম।
- সবচেয়ে কম জনঘনত্বপূর্ণ রাজ্য-অরুণাচল প্রদেশ : 17 জন প্রতি বর্গ-কিমি।
- সর্বাধিক জনবহুল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল–দিল্লি।
- সর্বাধিক জনবিরল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল-লাক্ষা ও মিনিকয় দ্বীপপুঞ্জ।
- সর্বাধিক স্বাক্ষর রাজ্য - কেরালা (93.91%)
- সবচেয়ে কম স্বাক্ষর রাজ্য বিহার ( 63.82%)
𖤂 জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সমস্যা : ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যাগুলি হল – (i) জনসংখ্যাবৃদ্ধি পেলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। অপুষ্টি, অনাহার বাড়ে। ফলে, শিশু-মৃত্যুর হার বাড়ে। (ii) জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক উন্নতি হ্রাস জনসংখ্যা পেতে থাকে। (iii) ক্রমশ জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে বেকারত্ব বাড়ে। (iv) জনসংখ্যা যত বাড়ে, ততই প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। (v) শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির উপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ে। (vi) অসামাজিক কাজকর্ম বৃদ্ধি পায়। (vii) শিল্পের উন্নতি ধীরগতিসম্পন্ন হয়। (viii) জমির উপর জনসংখ্যার চাপ ক্রমশ বাড়ে।
৯. ভারতে জনসংখ্যা বণ্টনের তারতম্যের কারণসমূহ : ভারতে জনসংখ্যার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল অসম বণ্টন। দেখা গেছে, ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় 50% (প্রায় 61 কোটি) বাস করে সমভূমিতে (মোট ভূমির প্রায় 23%)। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে জনসংখ্যার বণ্টন যেমন কম, তেমন মালভূমি অঞ্চলে বণ্টন মাঝারি। জনসংখ্যা বণ্টনের তারতম্যের কারণগুলিকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—(ক) প্রাকৃতিক কারণ, (খ) অপ্রাকৃতিক বা সাংস্কৃতিক কারণ।
[ক] প্রাকৃতিক কারণ (Physical Factors) : ভূ-প্রকৃতি, নদনদী, জলবায়ু, উদ্ভিদ, মৃত্তিকা, ভৌমজল, ভৌগোলিক অবস্থান প্রভৃতি জনসংখ্যা বণ্টনের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
(i) ভূ-প্রকৃতি : ভূ-প্রকৃতি ভারতে জনসংখ্যা বণ্টনের অন্যতম নিয়ন্ত্রক। ভূমির উচ্চতা, ঢাল, বন্ধুরতা, জলমগ্ন জলাভূমি প্রভৃতি উপাদানের উপর ভিত্তি করে জনবসতি গড়ে ওঠে। সিন্ধু, গঙ্গা ও উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চল সমতল হওয়ায় কৃষি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিল্পে উন্নত; তাই, জনঘনত্ব খুব বেশি। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল উঁচু, বন্ধুর এবং ঢাল বেশি হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প প্রভৃতি গড়ে উঠতে পারেনি, কৃষিকাজ কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল; তাই, জনসংখ্যা এখানে খুবই কম। তবে হিমালয়ের কয়েকটি বিশেষ স্থানে (দার্জিলিং, গ্যাংটক, সিমলা, মুসৌরি প্রভৃতি) প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্যের কারণে পর্যটন শিল্পে উন্নত হওয়ায় জনসংখ্যা বেশি। মালভূমি অঞ্চলগুলিতে ভূমির ঢাল ও উচ্চতা মধ্যম প্রকার। ফলে জন ঘনত্ব মাঝারি। তবে, মালভূমির কয়েকটি স্থানে প্রচুর খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়। খনিজের উপর ভিত্তি করে এখানে শিল্প গড়ে ওঠায় জনঘনত্ব বেশ বেশি।
(ii) নদ-নদী : ভারতের জনসংখ্যা বণ্টনে নদ-নদী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি নদী অববাহিকা উর্বর হওয়ায় জনসংখ্যা বেশি। প্রত্যক্ষভাবে নদীর মাধ্যমে জলসেচ, জলবিদ্যুৎ-উৎপাদন, পানীয় জল সরবরাহ করা হয়। নদী—যোগাযোগ-ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হওয়ায় নদী-উপত্যকায় শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। তাই, নদী- অববাহিকাগুলি জনাকীর্ণ। প্রাচীনকালে অধিকাংশ সভ্যতার বিকাশ নদী-অববাহিকাতেই গড়ে উঠেছিল।
(iii) জলবায়ু : মানুষের উপর জলবায়ুর প্রভাব অপরিসীম। তাই, জনসংখ্যার স্থানীয় বন্টন উষ্মতা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, আর্দ্রতা, শীতের প্রকোপ প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। উপকূলের জলবায়ু সারা বছর মনোরম বলে জনসংখ্যা বেশি। উত্তর-পূর্ব পাহাড়ি রাজ্যগুলোতে জলবায়ু স্যাঁতসেঁতে বলে জনসংখ্যা কম। আবার উচ্চ হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে অত্যধিক শৈত্য এবং থর মরু অঞ্চলে অত্যধিক গরম ও স্বল্প বৃষ্টির কারণে স্থানগুলি জন বিরল। জলবায়ুর প্রধান উপাদান-বৃষ্টিপাত, জনসংখ্যার বণ্টনকে সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বলা হয়, The Population Map of India follows the rainfall map কারণ, বৃষ্টি হলে কৃষিতে পর্যাপ্ত জল পাওয়া যায়।
(iv) মৃত্তিকা : মাটির গুণাগুণের উপর জনঘনত্ব নির্ভর করে। মাটির গঠন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য জনঘনত্বে তারতম্য ঘটায়। গঙ্গা সমভূমি ও উপকূলীয় সমভূমির মৃত্তিকা অত্যন্ত উর্বর বলে জনঘনত্ব বেশি। আবার, মালভূমি হওয়া সত্ত্বেও উর্বর রেগুর মৃত্তিকার কারণে ডেকান ট্র্যাপ অঞ্চল বেশ জনাকীর্ণ। ছোটোনাগপুরের ল্যাটেরাইট, দক্ষিণ ভারতে লাল মাটি এবং হিমালয় অঞ্চলের পজল মাটি অনুর্বর হওয়ায় জনঘনত্ব কম।
(v) জলাশয় ও ভৌমজল : জলনিকাশী ব্যবস্থা, ভৌমজল স্তরের গভীরতা ও প্রাপ্তি, জলাভূমির অবস্থান প্রভৃতি গ্রাম্য জনসংখ্যার বন্টনকে প্রভাবিত করে। থর মরুভূমির জনবণ্টন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জলাভূমির অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। বন্যাপ্রবণ অঞ্চলগুলিতে, যেখানে জলনিকাশী ব্যবস্থা উন্নত, সেখানে প্রচুর মানুষ বসবাস করে। সমভূমি অঞ্চলের মধ্যে যেখানে ভৌমজল স্তরের গভীরতা কম, সেখানে কৃষিকাজ উন্নত বলে জনসংখ্যাও বেশি।
(vi) বনভূমি : উত্তর-পূর্বের পার্বত্য অঞ্চল, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের গভীর বনভূমি—বসবাসের প্রতিকূল পরিবেশ হওয়ায় জনসংখ্যা কম। তবে, বনভূমি সীমান্ত অঞ্চলে বনজ সম্পদ (কাঠ, মধু, লতাপাতা) সংগ্রহের কারণে জনবসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়।
[খ] অর্থনৈতিক কারণ (Economic Factors) : প্রাকৃতিক কারণগুলির সাথে সাথে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণও জনসংখ্যা বন্টনে সমান ভূমিকা গ্রহণ করে।
(i) খনিজ সম্পদ : খনিজ উত্তোলক অঞ্চলে কাজের সুযোগের সম্ভাবনা বাড়তে থাকে; ফলে, ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে। ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চল ভারতের খনিজভাণ্ডার হওয়ায় জনঘনত্ব এখানে বেশি। একই কারণে, বাইলাডিলা, সালেম প্রভৃতি অতি জনাকীর্ণ।
(ii) শিল্প : শিল্পের উন্নতিতে কাজের সুযোগ বাড়ে; ফলে, বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্পাঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তাই, শিল্পাঞ্চলগুলিতে জনঘনত্ব অত্যধিক বেশি হয়। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর উভয় তীরে হলদিয়া, দুর্গাপুর, আসানসোল,মুম্বাই, পুনে, গুজরাট এই কারণেই অতি জনাকীর্ণ।
(iii) কৃষি ও পশুপালন : ভারতে গ্রামীণ জনসংখ্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। উর্বর মৃত্তিকা ও সমতল ভূমিভাগের কারণে গঙ্গা সমভূমি ও উপকূলীয় সমভূমিতে জনাধিক্য দেখা যায়। সমভূমিতে যেখানে জলসেচ ব্যবস্থা উন্নত, সেখানে
নিবিড় পদ্ধতিতে বছরে একাধিক বার ফসল উৎপাদন হয় বলে ঘন জন বণ্টন দেখা যায়। গুজরাটের উত্তর অংশ অনুর্বর হলেও পশুপালনের কারণে বেশি লোক বাস করে।
(iv) যোগাযোগ ব্যবস্থা : যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও জনসংখ্যার বণ্টন সর্বদাই সমানুপাতিক। সমভূমি অঞ্চলে জালের মতো সড়ক পথ, রেলপথ বিস্তৃত বলেই অতি জনাকীর্ণ। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুন্নতির কারণেই হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল—কম জনাকীর্ণ।
[গ] সামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণ :
(i) শহরায়ণ : শহরায়ণের প্রভাবে জনসংখ্যার ঘনত্ব ক্রমশ বাড়ে। শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব সর্বদা বেশি। তাই বৃহত্তর মুম্বাই, কলকাতা, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি স্থানে জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 6000 জন অপেক্ষা বেশি।
(ii) জীবিকার সুযোগ : উর্বর শস্য-শ্যামল ভূমি, শিল্পাঞ্চল, শহর প্রভৃতি মানুষের প্রাথমিক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান) সহজে মেটায় বলে উর্বর অঞ্চল, শহর ও নগরের দিকে মানুষের আগমন (Migration) ঘটে।
(iii) শিক্ষাকেন্দ্র : শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে দেশবিদেশ থেকে শিক্ষার্থী আসে, ফলে, জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। শান্তিনিকেতন, বারাণসী প্রভৃতি স্থানে এই কারণেই জনসংখ্যা বেশি।
(iv) ধর্মীয় স্থান : পরী কাশী, মথুরা প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচুর-দর্শনার্থীর আগমন হয়। দোকান, বাজার গড়ে ওঠে এবং বসতি বাড়তে থাকে।
(v) রাজনৈতিক কারণ ও সরকারি নীতি : রাজনৈতিক পরিবেশ, সরকারি ও বেসরকারি নীতি-অনসংখ্যা বিন্যাসের তারতম্য ঘটায়। 1947 সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার কারণেই সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জনসংখ্যার আধিক্য ঘটে। সরকার পরিকল্পনার মাধ্যমে উপনগরী গড়ে তুললে (যেমন—সল্টলেক, রাজারহাট) জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
(vi) ঐতিহাসিক স্থান : ঐতিহাসিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি (আগ্রা, পাটনা, মহিশুর প্রভৃতি)-তে স্বাভাবিক কারণেই জনসংখ্যার পুনর্বিন্যাস ঘটে।
(vii) পর্যটন ব্যবস্থা ও জনসাংক্ষিক কারণ (Demographic fctors) : যেমন- জন্মহার, মৃত্যুহার, পরিব্রাজন। প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি জনসংখ্যা বন্টনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। তবে, ভারতে জনসংখ্যা বণ্টনে কোনো একটি বিশেষ উপাদনের পরিবর্তে সম্মিলিতভাবে উপাদনগুলির কার্যকারিতার প্রভাবে জনবিন্যাস ঘটেছে।
১০. জনঘনত্ব অনুযায়ী ভারতের রাজ্যগুলির শ্রেণিবিভাগ (Classification of Indian States according to Population Density) : জনসংখ্যার ঘনত্বের মাধ্যমে জনসংখ্যা বণ্টনের তারতম্য আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা সম্ভব। বর্তমানে ভারতের গড় জনঘনত্ব 382 জন প্রতি বর্গ-কিমি হলেও দিল্লি, চণ্ডীগড় প্রভৃতি অঞ্চলে জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 6000 জনেরও বেশি। আবার অরুণাচল, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, মিজোরাম, প্রভৃতি অঞ্চলে জনঘনত্ব প্রতি বর্গ-কিমিতে 100 জনেরও কম। দিল্লি ভারতের সবচেয়ে জনঘনত্ব যুক্ত অঞ্চল (11,242 জন প্রতি বর্গ-কিমি) এবং বিহার সবচেয়ে বেশি জনঘনত্বপূর্ণ রাজ্য (1102 জন প্রতি বর্গ-কিমি) অরুণাচল প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে কম ঘনত্ব পূর্ণ রাজ্য (17 জন প্রতি বর্গ-কিমি)।
গড় জনঘনত্বের তারতম্য অনুযায়ী ভারতকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়: (1) অতি স্বল্প জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল, (2) স্বল্প জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল, (3) মধ্যম জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল, (4) অধিক জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল, (5) অত্যধিক জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল।
[1] অতি স্বল্প জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল (জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিমিতে 100 জনের কম) :
অঞ্চল : অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, সিকিম রাজ্য এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ — কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিমিতে 100 জনের কম। কারণ : (i) অনুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, সিকিমের, দুর্গম ভূ-ভাগ অঞ্চল পার্বত্য, প্রতিকূল জলবায়ু, গভীর বনভূমি, অনুন্নত কৃষি পদ্ধতি প্রভৃতি কারণে ঘন জনবসতি গড়ে উঠতে পারেনি। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও খনিজ সম্পদের অভাবে কুটিরশিল্প ছাড়া অন্যান্য শিল্প মোটেই গড়ে ওঠেনি। (ii) আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ মূল ভূ-ভাগ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। গভীর বনভূমি এবং অস্বাস্থ্যকর উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুর কারণে এখানে জন ঘনত্ব 50 জনেরও কম। তবে শ্রীনগর, গ্যাংটক, ইটানগর প্রভৃতি অঞ্চল পর্যটন শিল্পে উন্নত হওয়ায় জনঘনত্ব কিছুটা বেশি।
[2] স্বল্প জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল (জনঘনত্ব প্রতি বর্গ-কিমিতে 101-250 জন) :
অঞ্চল : মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ছত্তিশগড়, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর—এই নয়টি রাজ্যে জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 101-250 জন। কারণ : (i) জম্মু ও কাশ্মীর, মেঘালয়, মণিপুর ও নাগাল্যাণ্ড দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। গভীর বনভূমি, প্রতিকূল জলবায়ু, অনুন্নত কৃষি ও শিল্পের কারণে জনসংখ্যা অনেক কম । (ii) হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাঞ্চল পশ্চিম হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। (iii) ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশ মালভূমিতে অবস্থিত হওয়ায় ভূ-প্রকৃতি বন্ধুর এবং মৃত্তিকা অনুর্বর ল্যাটেরাইট-জাতীয় বলে কৃষিতে অনুন্নত। তবে স্থানে স্থানে খনিজ সম্পদ প্রাপ্তির উপর ভিত্তি করে শিল্প গড়ে ওঠায় জনঘনত্ব বেশ বেশি। (iv) রাজস্থান মরুভূমি অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় জনঘনত্ব কম। তবে, জলসেচ ব্যবস্থার সুবিধার কারণে রাজস্থানের পূর্বাংশ কৃষিতে উন্নত হওয়ায় জনঘনত্ব কিছুটা বেশি।
[3] মধ্যম জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল : (জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 251-450 জন) :
অঞ্চল : গোয়া, অসম, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, ত্রিপুরা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, গুজরাট, উড়িষ্যায় জনঘনত্ব মধ্যম প্রকার। কারণ : (i) অস্ত্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও উড়িষ্যায় ভূমিভাগ সমভূমি ও মালভূমির সমন্বয়ে গঠিত এবং সমভূমি কৃষিতে উন্নত ও মালভূমি অঞ্চল খনিজ-উত্তোলনে প্রসিদ্ধ। (ii) ঝাড়খণ্ড ভারতের খনিজ ভাণ্ডার হওয়ায় শিল্পে উন্নত, তাই, মালভূমি হওয়া সত্ত্বেও জনঘনত্ব মধ্যমপ্রকার। (iii) অসম ও ত্রিপুরা বাগিচা কৃষিতে (চা, আনারস প্রভৃতি) উন্নত। (iv) মহারাষ্ট্র ও গুজরাট—ভারতের দুটি প্রথম সারির শিল্পোন্নত রাজ্য হলেও মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চল মালভূমির অন্তর্গত এবং গুজরাটের পশ্চিম অংশ শুষ্ক মরুপ্রায় হওয়ায় জনঘনত্ব মাঝারি। (v) গোয়া—পর্যটন শিল্পে উন্নত এবং সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণের সুবিধা থাকায় মধ্যম প্রকৃতির জনবণ্টন ঘটেছে।
[4] অধিক জনঘনত্বযুক্ত অঞ্চল (জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 451-850 জন) :
অঞ্চল: উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও তামিলনাড়ু রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল–দাদরা ও নগরহাভেলিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। কারণ : (i) উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা—উর্বর পলিসমৃদ্ধ সমভূমিতে অবস্থিত। জলসেচ ব্যবস্থা প্রসারের স্মরণে কৃষিপদ্ধতি বেশ উন্নত। 'সবুজ বিপ্লব'-এর প্রভাব সর্বপ্রথম এখানেই দেখা যায়। কৃষিভিত্তিক শিল্পও এখানে বেশ উন্নত; তাই, জনঘনত্ব বেশি। তাছাড়া কৃষিজমিতে কাজের জন্য ভারতের অন্যান্য প্রান্ত থেকে প্রচুর শ্রমিক (Labour Migration) এখানে আসে। (ii) তামিলনাড়ুর কাবেরী অববাহিকা ও উপকূলীয় সমভূমি নিবিড় কৃষিতে উন্নত। মালভূমি অঞ্চল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় জনঘনত্ব বেশি।
[5] অত্যধিক জনঘনত্ব অঞ্চল : (জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 850 জনেরও বেশি) :
অঞ্চল : পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও কেরালা রাজ্য এবং দিল্লি, চণ্ডীগড়, পণ্ডিচেরি, লাক্ষাদ্বীপ ও দমন-দিউ–কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জনঘনত্ব অত্যন্ত বেশি, 850 জনের বেশি প্রতি বর্গ-কিমিতে। কারণ : (i) গঙ্গা বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকা অত্যন্ত উর্বর এবং জলসেচ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় নিবিড়ভাবে জমিতে বছরে একাধিকবার ফসল উৎপন্ন হয়। তাছাড়া হুগলি শিল্পাঞ্চল ভারতের প্রাচীনতম ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল হওয়ায় পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি থেকে এখানে প্রচুর মানুষের আগমন ( Migration) ঘটেছে। (ii) কেরালার উপকূল উর্বর মৃত্তিকা দ্বারা গঠিত সমতলভূমি। পার্বত্য অংশ বাগিচা ফসল (চা, কফি, রাবার, মশলা) উৎপাদনে বিখ্যাত এবং কয়াল ও সমুদ্র থেকে প্রচুর মাছ ধরার সুবিধা রয়েছে। (iii) বিহার উর্বর সমতল ভূ-ভাগ হওয়ায় কৃষিতে উন্নত। বিহারে জন্মহারও খুব বেশি। (iv) দিল্লি, চণ্ডীগড়, পন্ডিচেরি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ায় শাসনতন্ত্র, শিল্পও বাণিজ্যের কারণে শহরে পরিণত হয়েছে। (v) এই রাজ্যগুলি রেলপথ ও সড়ক পথ পরিবহনে প্রভূত উন্নত, এছাড়া নদী পথেও পরিবহন (বিশেষত গঙ্গা-নদী জলপথ পরিবহন) হয়ে থাকে। উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ব্যবসা-বানিজ্যের প্রসার ঘটেছে। এভাবে তৃতীয় ক্ষেত্রের কাজের পরিধি বিস্তৃত হওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে।
১১. মানব সম্পদ সম্পর্কে ধারণা (Concept of Human Resource) : মানব সম্পদ বলতে সাধারণভাবে মানুষকে ইঙ্গিত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে মানুষের শ্রম ও শক্তিই হল মানব সম্পদ। মানুষ তার শ্রম ও শক্তি প্রয়োগ করে প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করে। শ্রম ও শক্তির জোগান ও তার উৎকর্ষ সম্পদ উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক উপকরণ হিসাবে ভূগর্ভে সঞ্চিত কয়লা বা পেট্রোলিয়াম নিরপেক্ষ সামগ্রী, তা যখন মানুষ শক্তি ও শ্রম প্রয়োগ করে উত্তোলন ও পরিশোধন করে, তখন ওই নিরপেক্ষ সামগ্রী সম্পদে পরিণত হয় এবং মানুষের অভাব মোচনে সমর্থ হয়। কয়লা বা পেট্রোলিয়ামের কার্যকারিতা ও উপযোগিতা মানুষের শ্রম ও শক্তি প্রয়োগের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করতে গেলে প্রয়োজন হয় শক্তি ও শ্রমের। আবার এই শক্তি ও শ্রমের প্রাপ্যতা নির্ভর করে জনসংখ্যার ঘনত্ব, বণ্টন ও শ্রমদান ক্ষমতার উপর।
𖤂 শক্তি ও শ্রম : এক্ষেত্রে শক্তি ও শ্রম বলতে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদনমুখী শ্রম ও শক্তিকে বোঝায়। অর্থাৎ যে শক্তি ও শ্রম সম্পদ সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত হয়, তাই কেবল সম্পদসমীক্ষা ও অর্থনীতির আলোচনার ক্ষেত্রে স্থান পায়। উদ্দেশ্যহীন শ্রম নয়, কল্যাণমূলক উদ্দেশ্যে নিয়োজিত শ্রমই এখানে আলোচ্য বিষয়। অধ্যাপক মার্শালের মতে, 'কোনো কল্যাণমূলক উদ্দেশ্যে শরীর অথবা মনের যে আংশিক বা পূর্ণ প্রয়োগ করা যায় তাই শ্রম"। অধিক জনঘনত্বপূর্ণ অঞ্চলে বা দেশে সম্পদের চাহিদা যেমন বেশি শ্রমশক্তির প্রাপ্যতাও তেমন বেশি। কৃষিকাজের প্রসার, অধিকমাত্রায় খনিজ উত্তোলন, শিল্পোন্নয়ন ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজকর্মে বেশি মাত্রায় শ্রমশক্তির প্রয়োজন হয়। সম্পদ উৎপাদন কেবলমাত্র শ্রমশক্তির পরিমাণের উপর নির্ভর করে না, এর মানের উপরও নির্ভরশীল।
𖤂 শ্রমশক্তির মান : অধিক জনসংখ্যা অধিক সম্পদ সৃষ্টির সূচক নয়। জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা, বিচারবোধ, শ্রমদানের ইচ্ছা বা ঐকান্তিকতা প্রভৃতির উপর শ্রমশক্তি নির্ভরশীল। আডম স্মিথের মতে, কোনো দেশের সমৃদ্ধি সেই দেশের জনগণের শ্রম, দক্ষতা, কর্মকুশলতা ও বিচার-বিবেচনার ওপর নির্ভর করে, মোট জনসংখ্যার উপর না। উৎকৃষ্ট শ্রমশক্তির সাহায্যে বেশিমাত্রায় সম্পদ সৃষ্টি করে যেমন দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলা যায়, তেমনি মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যেরও ব্যবস্থা করা যায়। ভারত, নাইজিরিয়া, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে প্রাকৃতিক উপকরণের পরিমাণ, জনসংখ্যা ও শ্রমশক্তি বেশি থাকা সত্ত্বেও শ্রমশক্তির উৎকর্ষের অভাবে এইসকল দেশ সম্পদ সংগ্রহে তেমন উন্নতি করতে পারেনি। কিন্তু উৎকৃষ্ট শ্রমশক্তির কারণে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ বেশি মাত্রায় সম্পদ উৎপাদন করে অনেক বেশি অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে। বর্তমানে চিনও শ্রমশক্তির উৎকর্ষ বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এর প্রতিফলন ঘটেছে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে। শ্রমশক্তির দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল – (i) শ্রমশক্তির পরিমাণগত কটন এবং (ii) শ্রমশক্তির গুণগত দিক।
(i) শ্রমশক্তির পরিমাণগত বণ্টন : শ্রমশক্তির পরিমাণগত বন্টন বলতে বোঝায় জনসংখ্যার বিস্তার বা বণ্টন, যার থেকে শ্রমশক্তির জোগানের পরিমাপ করা যেতে পারে। জনসংখ্যার বন্টন সুষম হলে সম্পদ উৎপাদনে শ্রমশক্তির জোগানের অভাব হয় না। কিন্তু জনসংখ্যা তথা শ্রমশক্তির কেন্দ্রীভবন ঘটে অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্পদ উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকে ভূ-প্রাকৃতিক বা জলবায়ুগত দিক থেকে প্রতিকূল পরিবেশে। এক্ষেত্রে সম্পদ উন্নয়নে স্বামশক্তির স্থানান্তর প্রয়োজন হয়। শ্রম শক্তির স্থানান্তর ঘটিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আলাস্কায় খনিজ তেল, আপালেশিয়ান পার্বত্য অঞ্চলে কয়লা, রাশিয়ার স্তেপ অঞ্চলে কৃষির উন্নায়ন, তৈগা বনভূমির কাষ্ঠ সংগ্রহ, ভারতের ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে খনিজ উত্তোলন প্রভৃতি কার্য পরিচালনা করা হয়।
(ii) শ্রমশক্তির গুণগত দিক : শ্রমশক্তির গুণগত দিকগুলি হল—মানুষের দক্ষতা, স্বাস্থ্য, কর্মোদ্যোগ, দেশাত্মবোধ ইত্যাদি। কয়েক শত অদক্ষ, দুর্বল ও কর্মবিমুখ লোকজনের পক্ষে যে পরিমাণ সম্পদ উৎপাদন করা সম্ভব নয়, তা মাত্র কয়েকজন দক্ষ, সবল ও কর্মোদ্যোগী লোকজনের পক্ষে সম্ভব। অতএব কোনো দেশকে সম্পদশালী করতে ও দৃঢ় অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়তে হলে জাতির স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কর্মোদ্যোগের মাধ্যমে উৎসাহদান প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান তার ভগ্ন অর্থব্যবস্থা কয়েক দশকের মধ্যেই উক্ত গুণসম্পন্ন শ্রম শক্তির মাধ্যমে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে। বহু বছর আগে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের প্রাকৃতিক আনুকূল্যও আছে। তৎসত্ত্বেও দুর্বল শ্রমশক্তির কারণে আজও আমরা যথাযথ সম্পদ উন্নয়নে ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে পৌঁছাতে পারিনি।
𖤂 মানব সম্পদের উন্নয়ন (Development of Human Resource) : সৃষ্টির আদিতে মানুষ ছিল যাযাবর। খাদ্যের অন্বেষণে বনে বনে ঘুরে বেড়িয়েছে। কালক্রমে জ্ঞান ও বুদ্ধির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পশুর স্তর ছেড়ে মানবিক স্তরে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষাই মানুষকে এই স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। শিক্ষাই মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্প-সংস্কৃতি ও আবিষ্কার করার ক্ষমতা জোগায়। এই সকল গুণাবলি মানুষকে দক্ষ, উদ্যোগী, জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, স্বাস্থ্যবান ও মানসিকভাবে সচেতন করে তোলে। সুতরাং, মানব সম্পদ বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
𖤂 মানব সম্পদ উন্নয়নের শর্ত : 1) শিক্ষা : নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। 2) পানীয় জল ও সুষম খাদ্য : প্রত্যেকের জন্য পানীয় জল ও সুষম খাদ্যের জোগান দিতে হবে। 3) স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা : প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে হবে এবং চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করতে হবে। 4) প্রাথমিক শিক্ষা : নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রাথমিক শিক্ষাকে সকলের মৌলিক অধিকার হিসাবে সংবিধানে স্থান দিতে হবে। 5) বাসস্থান ও পুরব্যবস্থা : প্রত্যেকের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান ও উন্নত পুরব্যবস্থা করতে হবে। 6) কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা : শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী করতে হবে। 7) জীবিকার ব্যবস্থা : স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪) জনশিক্ষা বিস্তার : জনশিক্ষার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সারা দেশে তার বাস্তব রূপায়ণ করতে হবে। 9) কর্মের সুযোগ : কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। 10) দারিদ্র্য দূরীকরণ : দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। 11) পরিশ্রম ও দক্ষতার স্বীকৃতি : স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের পরিশ্রম ও দক্ষতার স্বীকৃতি দিতে হবে। 12) পরিবার পরিকল্পনা ও জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ : পরিবার পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। 13) আইন-শৃঙ্খলা : দেশে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি করতে হবে। দেশে সকলের জন্য আইন সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। 14) দেশ ও পৃথিবী সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি : দেশ ও পৃথিবী সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি সৃষ্টি করতে হবে। 15) স্থিতিশীল পরিস্থিতি : আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বোঝাপড়ার মাধ্যমে ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে। 16) সমাজ-সচেতনতা : মানুষের মধ্যে সমাজ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। 17) পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা : পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য মানুষকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। 18) সুপরিকল্পনা : দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এবং ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে সকল মানুষ শিক্ষিত, সংস্কৃতিসম্পন্ন, সামাজিক সচেতন ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। উল্লেখিত শর্তগুলির সঠিক রূপায়ণ হলে মানব সম্পদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটবে এবং পৃথিবী সম্পদে পরিপুর্ণ হবে।
⚡Highlights Points & Question Answer
✅ ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ আদমশুমারি (1881 সালে) নেতৃত্ব দেন W. C. Plowden
✅ ভারতের আধুনিক জনগণনার জনক হলেন ডব্লু ডব্লু হান্টার।
✅আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্যভাবে জন্মহার হ্রাসের ঘটনাকে ‘বেবি বাস্ট’ (baby bust) বলা হয়।
✅ 'Essay on the Application of Capital and Land' প্রবন্ধটি রচনা করেন এড্ওয়ার্ড ওয়েস্ট।
✅ 'The Principle of Political Economic' গ্রন্থটি লেখেন Henry Sidgwick.
✅ Cannan রচিত গ্রন্থ ‘Weath’এ কাম্য জনসংখ্যার ধারনা পাওয়া যায়।
✅ 'The Population Problem: A Study in Evolution-1923'এন্থটি লেখেন সানডারস্।
✅পৃথিবীতে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয় 43 বছরে। অনুরূপভাবে ইংল্যান্ডে 280 বছরে এবং ভারতে 35 বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয় ।
✅ Demoko তার ভাষায় বলেন ‘গাণিতিক ঘনত্বের তুলনায় শরীরবৃত্তীয় ঘনত্ব উন্নত ধরনে।'
✅ উন্নত দেশের জনগণ দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কাজের সাথে বেশি যুক্ত থাকে।
✅ উন্নত দেশগুলি হল—আমেরিকা (USA), কানাডা (Canada), জার্মানি (Germany), G-8 সদস্য দেশ।
✅যে কোনো সমচরিত্রের বস্তুকে কোহট বলা হয়। জনসংখ্যা ভূগোলে 0-5 বৎসর বয়সী শিশুদের কোহট বলে।
✅ উন্নত দেশের পিরামিডগুলি সাধারণত উত্তল, ঘণ্টা, ন্যাসপাতি আকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু অনুন্নত শ্রেণির ও উন্নয়নশীল দেশগুলির পিরামিডগুলি সাধারমত ত্রিভুজ ও ধনুকের মতো হয়।
✅ 'আদম সুমারি' শব্দটির অর্থ হল 'জনগননা'।
✅ ভারতে প্রতি 10 বছর অন্তর জনগননা করা হয়।
✅ ভারতে জনগননা শুরু হয় 1871 সালে।
✅Registration পদ্ধতি সর্বপ্রথম চালু হয়েছে চিন দেশে।
✅1990 খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম Human Development Report প্রকাশিত হয়।
✅1976 খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার 'ন্যাশনাল পপুলেশান পলিসি' গ্রহণ করে।
✅পরিব্রাজন সম্পর্কিত ‘মহাকর্ষ মডেলের' প্রবক্তা রিলি (1929 খ্রি.) লি-পরিব্রাজন সম্পর্কিত মডেলটি 1965 সালে প্রকাশ করেন।
✅ র্যাভেনস্টাইন তাঁর পরিব্রাজন সম্পর্কিত মডেল উদ্ভাবন করেন 1885 সালে।
✅ ‘এক সন্তান নীতি’ চালু হয়েছে চিনে (1979 খ্রি.)।
✅ ভারতে ‘ছোট পরিবার, সুখী পরিবার' এ স্লোগান প্রচার করা হয় চতুর্থ পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনায়।
✅ ভারতে ‘একটি পরিবার, একটি সন্তান' এই স্লোগান প্রচার করা হয় একাদশ পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনায়।
✅ কার্ল মার্কসের রচিত গ্রন্থ হল 'Law of Population'.
✅ Thomas Robert Malthus 1798 খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচিত 'An essay on the principle of population' প্রবন্ধে সর্বপ্রথম জনসংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত
✅জনবিজ্ঞানী লি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'A Teory of Migration' এ আকর্ষণ বিকর্ষণ ধারনার মতবাদ প্রদান করে।
✅ কার্ল মার্কস জনসংখ্যা নীতি সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে 1881 খ্রিঃ Capital A Critical Analysis of Capitalist Production গ্রন্থটি প্রকাশ করেন।
১. আদমশুমারি বা সেনসাস?
☞ কোনো নির্দিষ্ট দেশে নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনসংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার সার্বিক কর্মসূচিকে আদমশুমারি বা সেন্সাস বলে।
২. কার্যকর জমি?
☞ ভূ-পৃষ্ঠের যেসব জমি মানুষের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয় ও সম্পদ সৃষ্টি হয়, তাদের কার্যকর জমি বলে। এই জমি দৈৰ্ঘ্য, প্রস্থ ও উৎপাদন ক্ষমতা সমন্বিত ত্রিমাত্রিক।
৩. কাম্য জনসংখ্যা?
☞ কোনো দেশের সম্পদকে পরিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জনসংখ্যা হলো কাম্য জনসংখ্যা। কাম্য জনসংখ্যা হলো অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সর্বাধিক অনুকূল জনসংখ্যা। অধ্যাপক এডউইন ক্যানন কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের প্রবক্তা।
৪. জনাকীর্ণতা?
☞ কোনো দেশে বা কোনো অঞ্চলে প্রাপ্ত সম্পদের তুলনায় মোট জনসংখ্যা বেশি হলে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়, তাকে জনাকীর্ণতা বলে। এক্ষেত্রে মোট কার্যকর জমি অপেক্ষা মোট জনসংখ্যা বেশি হয়। এই জনাকীর্ণতা দুই প্রকার হয়। যথা— ➊ পরম জনাকীর্ণতা: সম্পদের সর্বাধিক বিকাশ সত্ত্বেও জীবনযাত্রার মান কম হলে এই জনাকীর্ণতা সৃষ্টি হয়। ➋ আপেক্ষিক জনাকীর্ণতা: বর্তমান সম্পদের অপর্যাপ্ত বিকাশ ও ভবিষ্যতে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির সম্ভাবনার কারণে এই জনাকীর্ণতার সৃষ্টি হয়।
৫. জনস্বল্পতা?
☞ কোনো দেশে বা কোনো অঞ্চলে প্রাপ্ত সম্পদের তুলনায় মোট জনসংখ্যা কম হলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাকে জনস্বল্পতা বলে। এক্ষেত্রে মোট জনসংখ্যা মোট কার্যকর জমি অপেক্ষা কম হয়।
৬. ফিকানডিটি?
☞ সন্তানধারণ এবং জন্মদান ক্ষমতাকে ফিকানডিটি বলে।
৭. বেবি বুম?
☞ একসঙ্গে যদি অনেক শিশুর জন্ম হয়, তখন তাকে বেবি বুম বলে। একসময় চিনে এই বেবি বুম বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছিল। 2007 সালের আগস্ট মাসটি জ্যোতিশশাস্ত্রের দিক দিয়ে শুভ হওয়ায় এই মাসে অনেক মা তাদের শিশুর জন্ম দিয়ে বেবি বুম ঘটিয়েছিল।
৮. গোত্রপুঞ্জ?
☞ একটি নির্দিষ্ট সূচকের ভিত্তিতে চিহ্নিত মানবগোষ্ঠীকে কোর্ট বলে। মূলতঃ রোমান সৈন্যদলের ইউনিটকে কোর্টে বলা হয়। কোহর্টের মূল ধারণা হলো—একই ধরনের একই শ্রেণির অন্তর্গত ব্যক্তিসমূহের দ্বারা একই ধরনের শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং সুসংহত কার্যকলাপ সংগঠিত হবে।
৯. অতি-জনাকীর্ণতা?
☞ কোনো দেশের জনসংখ্যা সেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় অত্যধিক বেশি হলে তাকে জনাধিক্য বা অতি-জনাকীর্ণতা বলে।
১০. জনবিস্ফোরণ?
☞ জনবিস্ফোরণ শব্দটি জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধিকে প্রকাশ করে। কোনো অঞ্চলে প্রধানত চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে জন্মহারের তুলনায় মৃত্যুহার হঠাৎ কমে গেলে জনসংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। জনসংখ্যার এরূপ বৃদ্ধিকে জনবিস্ফোরণ বলে। কোনো দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দুই শতাংশ ছাড়িয়ে গেলে দেশে জনবিস্ফোরণ ঘটেছে ধরা হয়।
১১. অগ্রগামী জনসংখ্যা?
☞ যেসব দেশে, জন্ম ও মৃত্যুহার উভয়ই বেশি হওয়ায় জনসংখ্যা পিরামিডের ভূমি বেশি বিস্তৃত এবং মস্তকদেশ তীক্ষ্ণ, এরূপ পিরামিডবিশিষ্ট দেশসমূহের জনসংখ্যাকে অগ্রগামী জনসংখ্যা বলে।
১২. পশ্চাদ্গামী জনসংখ্যা?
☞ যেসব দেশে জন্মহার ও মৃত্যুহার উভয়ই কম হওয়ায় জনসংখ্যা পিরামিডের ভূমি ও মস্তকদেশে কম প্রশস্থ। এরূপ পিরামিডবিশিষ্ট দেশসমূহের জনসংখ্যাকে পশ্চাদগামী জনসংখ্যা বলে।
১৩. জনসংখ্যার অভিক্ষেপ?
☞ কোনো দেশের বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভবিষ্যৎ জনসংখ্যা সম্বন্ধে পূর্বানুমান করাকে জনসংখ্যার অভিক্ষেপ বলে।
১৪. গাণিতিক ঘনত্ব?
☞ মোট জনসংখ্যা ও মোট জমির অনুপাতকে গাণিতিক ঘনত্ব বলে।
১৫. কৃষি ঘনত্ব?
☞ নির্দিষ্ট পরিমাণ কৃষিজমি এবং এর মধ্যে কৃষিকাজে নিয়োজিত লোকের সংখ্যাকে কৃষি ঘনত্ব বলে।
১৬. প্রত্যাশিত আয়ু?
☞ জন্মানোর পরে নবজাত শিশু কতদিন বাঁচবে তার গড় হিসেব হলো প্রত্যাশিত আয়ু। মানব উন্নয়নের একটা গড় ধারণা প্রত্যাশিত আয়ু থেকে পাওয়া যায়।
১৭. আকর্ষক কারণ?
☞ যে সব অনুকূল কারণগুলির জন্য মানুষ অন্যত্র গমন করে, সেই কারণগুলিকে আকর্ষক কারণ (Pull Factor) বলে।
১৮. বিতাড়ক কারণ?
☞ যে সব প্রতিকূল কারণের প্রভাবে মানুষ আর বাসস্থান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়, তাকে বিতাড়ক কারণ (Push Factor) বলে।
১৯. মেধা প্রবাহ?
☞ উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশ থেকে বুদ্ধিজীবী, শীর্ষ ব্যবস্থাপক, গবেষক, বিজ্ঞানী প্রমুখের উন্নতদেশে দীর্ঘমেয়াদি। স্থানান্তরকে মেধা প্রবাহ বলে। উন্নতিশীল দেশের সাপেক্ষে এই বহিমুখী দেশান্তর হলো ব্রেন ড্রেন।
২০. ব্রেন গেন?
☞ উন্নত দেশগুলিতে কাজের উপযুক্ত পরিবেশ ও স্বচ্ছল জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে যখন উন্নতিশীল দেশের মেধাবী মানুষ, দক্ষ বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও প্রযুক্তিবিদ চলে আসেন, তখন উন্নতদেশের সাপেক্ষে এই অন্তর্মুখী প্রচরণকে বলে ব্রেন গেন।
২১. অভিবাসন বা ইমিগ্রেশন (Immigration)?
☞ কোনো বিদেশি নাগরিক যখন কোনো একটি দেশে বসবাস করার উদ্দেশ্যে চলে আসেন, তখন সেই দেশের সাপেক্ষে অন্তর্মুখী পরিব্রাজনকে অভিবাসন বা ইমিগ্রেশন বলে।
২২. প্রবাসন বা এমিগ্রেশন (Emigration)?
☞ কোনো দেশের কিছু নাগরিক যখন অন্য কোনো দেশে বসবাসের উদ্দেশ্যে চলে যান, তখন এই বহির্মুখী পরিব্রাজনকে প্রবাসন বা এমিগ্রেশন বলে।
২৩. উৎসস্থল (Place of Origin)?
☞ যে দেশ বা যে স্থান ছেড়ে পরিব্রাজক অন্যত্র চলে যায়, তাকে উৎসস্থল বলে।
২৪. গন্তব্যস্থল (Place of Destination)?
☞ যে স্থানে বা দেশে পরিব্রাজক যাত্রা করেন সেইস্থানকে পরিব্রাজনের গন্তব্যস্থল বলে।
২৫. অন্তর্মুখী পরিব্রাজন (In-Intigration)?
☞ গন্তব্যস্থলে আগমনের ঘটনাকে অন্তর্মুখী পরিব্রাজন বলে এবং যে ব্যক্তি এই পরিব্রাজনে অংশগ্রহণ করে তাকে অন্তর্মুখী পরিব্রাজক বলে।
২৬. বহির্মুখী পরিব্রাজন (Out-Mitration)?
☞ পরিব্রাজনে উৎসস্থল পরিত্যাগের ঘটনাকে বহির্মুখী পরিব্রাজন বলে এবং যে ব্যক্তি বহির্মুখী পরিব্রাজক বলে।
২৭. স্থূল পরিব্রাজন (Gross Migration)?
☞ অন্তর্মুখী পরিব্রাজন বা অভিবাসন এবং বহির্মুখী পরিব্রাজন বা প্রবাসনের যোগফলকে স্থূল বা গ্রস পরিব্রাজন বলে।
২৮. নিট পরিব্রাজন (Net Migration)?
☞ বহির্মুখী পরিব্রাজন বা প্রবাসনের এবং অন্তর্মুখী পরিব্রাজন বা অভিবাসনের বিয়োগফলকে নিট পরিব্রাজন বলে।
২৯. পরিব্রাজনের ধারা/ প্রবাহ ( Stream of Migration)?
☞ কোনো এক নির্দিষ্ট সময়কালে একটি নির্দিষ্ট উৎসস্থল থেকে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের দিকে মোট যতবার পরিব্রাজন ঘটে, সেই মোট চলন সংখ্যাকে পরিব্রাজন প্রবাহ বা ধারা বলে।
৩০. কার্যকর পরিব্রাজন (Effective Migration)?
☞ দুটি স্থানের মধ্যে নীট পরিব্রাজনের সঙ্গে ওই দুটি স্থানের জনসংখ্যার স্থানান্তরের অনুপাতকে কার্যকর পরিব্রাজন বলে।
৩১. পরিব্রাজনের ভারসাম্য?
☞ অন্তঃপরিব্রাজন এবং বহিঃপরিব্রাজনের পরিমাণ যদি শূন্য হয়, তখন তাকে পরিব্রাজনের ভারসাম্য বলে।
NEXT PAGE