সমাস কাকে বলে?
‘সমাস' শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো 'সংক্ষেপ'। 'সমাস' শব্দের ব্যাকরণগত অর্থ হলো ‘পরস্পর অর্থ সম্বন্ধযুক্ত দুই বা তার বেশি পদ মিলে একপদে পরিণত হলে, তাকে বলা হয় সমাস।
(১) ঋষি বিশ্বের মিত্র রাজদরবারে এলেন।
(২) এ কাব্যকাহিনি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল নিয়ে।
ওপরের বাক্য দুটি পড়তে গেলে দুটি বাক্যের চিহ্নিত জায়গাগুলিতে আমাদের জিভ যেন হোঁচট খায়। প্রথম বাক্যে বিশ্বের মিত্র পদ দুটি ও দ্বিতীয় বাক্যে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল পদ তিনটি একসঙ্গে জুড়ে গেলে পাঠ সুখকর, প্রাঞ্জল ও মধুর হয়ে ওঠে। যদি তাই হয়, তাহলে বাক্য দুটি কী হয় দেখা যাক—
(১) ঋষি বিশ্বামিত্র রাজদরবারে এলেন।
(২) এ কাব্যকাহিনি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল নিয়ে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বাক্যে পদের মিলনে পাঠ হয়েছে সুখকর, প্রাঞ্জল ও মধুর। লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য যে, প্রথম ও দ্বিতীয় বাক্যে “বিশ্বের মিত্র' ও 'স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল'- (১) পদগুলি পাশাপাশি অবস্থিত, (২) পারস্পরিক অর্থ সম্পর্ক যুক্ত, (৩) অর্থ সম্পর্কযুক্ত বলেই দুই বা দুয়ের বেশি পদ একপদে পরিণত হয়েছে এবং (৪) বক্তব্য-বিষয় পাঠ সুখকর, প্রাজ্জ্বল ও মধুর হয়েছে।
মনে রাখতে হবে ‘পদের মিলনের ক্ষেত্রে দুই বা দুয়ের বেশি পদের একত্রীকরণ হতে পারে।' প্রথম বাক্যে বিশ্বের ও মিত্র দুই পদের, দ্বিতীয় বাক্যে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল তিন পদের মিলন হয়েছে। দুই পদের বেশি পদ জুড়ে সমাস হলে তা হয় বহুপদ সমাস। 'স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল' বহুপদ সমাস। তিন পদ জুড়ে এই
সমাস হয়েছে। এরকম-
চার পদ জুড়ে সমাস : শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ।
পাঁচ পদ জুড়ে সমাস : চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক।
ছয় পদ জুড়ে সমাস : কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মোহ-মাৎসর্য।
নয় পদ জুড়ে সমাস : প্রবর-নৃপ-মুকুট-মণি-মরীচি-চয়-চর্চিত-চরণ-যুগল।
বাংলা সাধু গদ্যে এরকম বহুপদ সমাসের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর সমসাময়িক, এমনকি তাঁর পরবর্তীকালের লেখকরাও সমাসবহুল গদ্য রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই রীতি এসেছিল সংস্কৃত থেকে। শুধু সাধু গদ্যে নয়, গানেও বহুপদ সমাসের ব্যবহার হয়েছে। যেমন- ‘শুভ্র জ্যোৎস্না-পুলকিত যামিনী’, ‘জনগণমন-অধিনায়ক’, ‘ভুবনমনোমোহিনী’, ‘নীলসিন্ধুজলধৌতচরণতল’ ইত্যাদি।
কিন্তু চলিত বাংলায় বহুপদ সমাসের ব্যবহার নেই বললেই চলে। দুই পদ সমাসের ব্যবহার বেশি। তবে বহুল বা ব্যাপক ব্যবহার নয়। কারণ সমাসবদ্ধ পদের সংখ্যা বেশি হলে ভাষার স্বাভাবিক চলন বা সাবলীল গতি পদে পদে ব্যাহত হয়।
❏ সমাস সংক্রান্ত পরিভাষা ও তাদের ব্যাখ্যা / ব্যাসবাক্য সহ সমাস নির্ণয় কর :
- ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য : সমাসবদ্ধ পদকে ভাঙলে বা ব্যাখ্যা করলে যে বাক্য বা বাক্যাংশটি (অর্থাৎ, সমস্যমান পদসমষ্টি) পাওয়া যায়, তাকে ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য বলে। যেমন- পঙ্কজ = পঙ্কে জন্মে যা। 'পঙ্কজ' পদটি ব্যাখ্যা করতে 'পঙ্কে জন্মে যা এই অংশটি পাওয়া গেছে। এটি ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য ।
- সমস্যমান পদ : ব্যাসবাক্যের অন্তর্গত এক-একটি পদকে বলা হয় সমস্যমানপদ। যেমন— পথচলা = পথে চলা। ‘পথে’ ও ‘চলা’ সমস্যমান পদ।
- সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদ : দুই বা তার বেশি পদ মিলিত হয়ে যে পদ গঠিত হয়, তা সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদ। যেমন—পথে চলা = পথচলা। এতে ‘পথে’ ও ‘চলা’ দুটি পদ মিলিত হয়ে ‘পথচলা' পদ গঠিত হয়েছে। সুতরাং, ‘পথচলা’ সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদ। সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদের অপর নাম সমাস ।
- পূর্বপদ ও পরপদ : ব্যাসবাক্যের প্রথমাংশের পদ পূর্বপদ, শেষাংশের পদ পরপদ। যেমন—অর্থগৌরব = অর্থের গৌরব। ‘অর্থের পূর্বপদ, ‘গৌরব’ পরপদ।
❏ সমাস সংক্রান্ত পরিভাষার লেখচিত্র :
সমাসে পদের অর্থপ্রধান্য একটি লক্ষণীয় বিষয়। কোনো সমাসে পরপদের, কোনো সমাসে পূর্ব ও পর উভয় পদের আবার কোনো সমাসে পূর্ব-পর ছাড়া অন্য পদের অর্থপ্রাধান্য ঘটে। একনজরে দেখার মতো একটি তালিকা নীচে দেওয়া হলো-
(ক) পরপদের অর্থপ্রাধান্য: তৎপুরুষ, কর্মধারয়, দ্বিগু।
(খ) উভয় পদের অর্থপ্রাধান্য : দ্বন্দ্ব।
(গ) অন্য পদের অর্থপ্রাধান্য: বহুব্রীহি।
(ঘ) পূর্বপদের অর্থপ্রাধান্য: অব্যয়ীভাব (অবশ্য এতে সমাসবদ্ধ পদটি অব্যয়রূপ লাভ করে।)
পূর্বপদ ও পরপদ বিশেষ্য, বিশেষণ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের পদ হতে পারে। যেমন—জাতিধর্ম (বিশেষ্য-বিশেষ্য), ইতর-ভদ্র (বিশেষণ-বিশেষণ), তুমি-আমি (সর্বনাম-সর্বনাম), লেখে-পড়ে (ক্রিয়া-ক্রিয়া), কানাকড়ি (বিশেষণ-বিশেষ্য), মিঠেকড়া (বিশেষণ-বিশেষণ), শ্বেতপদ্ম (বিশেষণ-বিশেষ্য)ইত্যাদি।
- Karok Bengali Grammar
- Somas Bengali Grammar
- Purush in Bengali Grammar
Somas in Bengali Grammar
❏ সমাসের শ্রেণিবিভাগ : সমাসকে নানাভাগে ভাগ করা হয়। সংস্কৃত ব্যাকরণ মতে সমাস প্রধানত (4) চার প্রকার। যেমন- ① দ্বন্দ্ব সমাস, ② তৎপুরুষ সমাস, ③ বহুব্রীহি সমাস ও ④ অব্যয়ীভাব সমাস। ভাষাচার্য ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সমাসকে প্রথমত তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন—(ক) সংযোগমূলক, (খ) ব্যাখ্যামূলক ও (গ) বর্ণনামূলক। সংযোগমূলক সমাসের অন্তর্গত হলো দ্বন্দ্ব ; ব্যাখ্যামূলক সমাসের অন্তর্গত হলো তৎপুরুষ, দ্বিগু, কর্মধারয় ও অব্যয়ীভাব; বর্ণনামূলক সমাসের অন্তর্গত হলো বহুব্রীহি। কর্মধারয় ও দ্বিগু তৎপুরুষ সমাসের প্রকারভেদ মাত্র। সমাসের বর্তমান শ্রেণিবিভাগ হলো ৯টি । যথা- ① দ্বন্দ সমাস ② কর্মধারয় সমাস ③ তৎপুরুষ সমাস ④ বহুব্রীহি সমাস ⑤ দ্বিগু সমাস ⑥ অব্যয়ীভাব সমাস ⑦ নিত্যসমাস ⑧ অলোপ সমাস ⑨ বাক্যাশ্রয়ী সমাস।
① দ্বন্দ সমাস : ‘দ্বন্দ্ব’ বলতে আমরা ‘কলহ, বিবাদ' বুঝি । তা ছাড়া ‘দ্বন্দ্ব' শব্দের অর্থ‘যোগ, জোড়া' ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাকরণগত অর্থ 'পূর্ব ও পর পদের সমান অর্থপ্রাধান্য থাকে এমন সংযোগমূলক সমাস। 'ব্যাসবাক্যে সমস্যমান পূর্বপদ ও পরপদ সংযোজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত হলে এবং সমাসনিষ্পন্ন হওয়ার পর উভয় পদের সমান অর্থপ্রাধান্য থাকলে, এরকম সমাসকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন-কর্ণ ও অর্জুন = কর্ণার্জুন।
কর্ণ
[পূর্বপদ, বিশেষ্য]
ও
[সংযোজক অব্যয়]
অর্জুন কর্ণার্জুন
[পরপদ, বিশেষ্য] = [পূর্ব ও পর দুই পদের অর্থ বজায় ও প্রধান]
দ্বন্দ্ব সমাসে অপেক্ষাকৃত ছোটো আকারের পদটি সাধারণত আগে বসে। যেমন- মা-বাবা, রুই-কাতলা ইত্যাদি। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। গৌরববোধক শব্দ দীর্ঘাকৃতি হওয়া সত্ত্বেও প্রথমে বসে। যেমন—আত্মীয়-বন্ধু, সেপাই- সাস্ত্রি, শাশুড়ি-বউ ইত্যাদি।
- পূর্ব ও পর উভয় পদ বিশেষ্য : ছেলে ও মেয়ে = ছেলে-মেয়ে, শিব ও দুর্গা = শিব-দুর্গা, নাড়ি ও ভুঁড়ি নাড়ি-ভুঁড়ি, অন্ন ও বস্ত্র = অন্ন-বস্ত্র, জন্ম ও মৃত্যু = জন্ম-মৃত্যু। এরকম - জামা-কাপড়, ঝি-জামাই, ভাই-বোন, পিতা-মাতা, বর-বউ, মা-বাপ, বাপ-দাদা, বউ-ব্যাটা, ভূত-পেতনি, মশা-মাছি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দুধ-দই, জল-কাদা, ঝড়-বাদল, দেনা-পাওনা, গোরু-বাছুর, মেয়ে-পুরুষ ইত্যাদি।
- পূর্ব ও পর উভয় পদ বিশেষণ : ন্যায় ও অন্যায় = ন্যায়-অন্যায়, ধনী ও গরিব = ধনী-গরিব, উচ্চ ও নীচ = উচ্চ-নীচ। এরকম-লঘু-গুরু, ছোটো-বড়ো, দীন-দুঃখী, আঁকা-বাঁকা, কাটা-ছেঁড়া, বাঁকা-ট্যারা, কাঁচা-পাকা ইত্যাদি।
- পূর্ব ও পর উভয় পদ ক্রিয়াপদ : ভাঙে ও গড়ে = ভাঙে-গড়ে, উঠে ও পড়ে = উঠে-পড়ে, পড়ি ও মরি = পড়ি- মরি। এরকম—উঠ-বস, চেয়ে-চিন্তে, নাচ-গান, হেসে-খেলে, আসে যায়, হারি-জিতি, খেয়ে মেখে ইত্যাদি ।
⚡এখানে লক্ষ করো : (১) পূর্ব ও পর উভয় পদ বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াবা সর্বনাম ; (২) অথবা পূর্ব ও পরপদ একই অর্থবিশিষ্ট; (৩) অথবা পূর্ব ও পরপদ অনুচর, সহচর, প্রতিচর অর্থপ্রকাশক ; (৪) পূর্ব ও পরপদ সংযোজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত; (৫) সমাসবদ্ধ পদে উভয় পদের অর্থপ্রাধান্য থাকলে দ্বন্দ্ব সমাস।
- পূর্ব ও পর উভয় পদ সর্বনাম : যাকে ও তাকে = যাকে-তাকে, তুমি ও আমি = তুমি-আমি, এর ও তার = এর-তার, যেটা ও সেটা = যেটা-সেটা, এরা ও ওরা = এরা-ওরা, এটা ও ওটা = এটা-ওটা ইত্যাদি।
- সমার্থক দ্বন্দ্ব : যে দ্বন্দ্ব সমাসে পূর্বপদ ও পরপদ একই অর্থবিশিষ্ট পৃথক পৃথক শব্দ হয়, তাকে সমার্থক দ্বন্দ্ব বলে। যেমন—হাট ও বাজার = হাট-বাজার, রাজা ও বাদশা = রাজা-বাদশা, জন্তু ও জানোয়ার = জন্তু-জানোয়ার। এরকম—ডাক্তার-বদ্যি, ছেলে-ছোকরা, মামলা-মোকদ্দমা, মাঠ-ময়দান, পাহাড়-পর্বত, কাজ-কর্ম ইত্যাদি।
- ইত্যাদি অর্থবোধক দ্বন্দ্ব : অনুরূপ বা সমজাতীয় ভাব প্রকাশের জন্য অনুচর, সহচর, প্রতিচর, বিকার, অনুকার প্রভৃতি অর্থপ্রকাশক শব্দের মিলনে 'ইত্যাদি' অর্থবোধক দ্বন্দ্ব হয়।
- 'সহচর' অর্থদ্যোতক শব্দ যোগে : দেহ ও মন = দেহ-মন। এরকম—গোঁফ-দাড়ি, ঘর-বাড়ি ইত্যাদি।
- 'অনুচর' অর্থপ্রকাশক শব্দ যোগে : চেয়ার ও টেবিল = চেয়ার-টেবিল, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি।
- 'প্রতিচর' অর্থপ্রকাশক শব্দ যোগে : আকাশ ও পাতাল = আকাশ-পাতাল। এরকম- পাপ-পুণ্য, গুরু-শিষ্য ইত্যাদি।
- 'বিকার' অর্থপ্রকাশক শব্দ যোগে : ঠাকুর ও ঠুকুর = ঠাকুর-ঠুকুর। এরকম—কাঁদা-কাটা, গাল-গল্প ইত্যাদি।
- 'অনুকার' অর্থপ্রকাশক শব্দ যোগে : তেল ও টেল = তেল-টেল। এরকম—জল-টল, বাসন-কোশন ইত্যাদি।
- একশেষ দ্বন্দ্ব : যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদগুলির মধ্যে একটিমাত্র পদ থাকে, অন্য পদগুলি নিবৃত্ত হয় তাকে একশেষ দ্বন্দ্ব বলে। যেমন- সে ও তুমি = তোমরা, তুমি, সে ও আমি = আমরা।
- বহুপদনিষ্পন্ন দ্বন্দ্ব : দুয়ের বেশি পদের মিলনেও দ্বন্দ্ব হয়। যেমন-তেল, নুন ও লকড়ি = তেল-নুন-লকড়ি। এরকম—রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম ইত্যাদি।
❏ দ্বন্দ্ব সমাসের কয়েকটি বিশিষ্ট উদাহরণ : জায়া ও পতি = দম্পতি, জায়াপতি ; অহঃ ও নিশা = অহর্নিশ ; অহঃ ও রাত্রি = অহোরাত্র ; দিবা ও রাত্রি = দিবারাত্র; কুশ ও লব = কুশীলব।
② কর্মধারয় সমাস : বিশেষণ ও বিশেষ্য বা বিশেষ্য ও বিশেষ্য কিংবা বিশেষণ ও বিশেষণ পদে সমাস হলে এবং পরপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হলে, তাকে কর্মধারয় সমাস বলে। লক্ষণীয় যে, তৎপুরুষ ও কর্মধারয় উভয় সমাসে পরপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়। এজন্য কর্মধারয়কে তৎপুরুষের প্রকারভেদ বলা হয়।
নীল যে উৎপল = নীলোৎপল। এতে পূর্বপদ ‘নীল' বিশেষণ, পরপদ ‘উৎপল’বিশেষ্য এবং সমাসনিষ্পন্ন হওয়ার পর উৎপলের অর্থ প্রধান হয়েছে। [কর্মধারয়— কর্মধারয় সমাস; ব্যাসবাক্য : যে করে (অর্থাৎ কর্ম), সেই ধরে (অর্থাৎ ধারয়)।] ব্যাসবাক্যতেই কর্মধারয়ের অর্থ পরিষ্কার। যিনি কর্তা তিনিই ধারক। অর্থাৎ একই ব্যক্তি, একই অস্তিত্ব। দুই ব্যক্তির দুই রূপ নয়। যেমন–‘রাজর্ষি' একই ব্যক্তি। যিনি রাজা তিনিই ঋষি। এটিই কর্মধারয় সমাসের বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যই কর্মধারয়কে তৎপুরুষ ও দ্বন্দ্ব থেকে স্বতন্ত্র করেছে।
⚡এখানে লক্ষ করো : (১) পূর্ব ও পরপদ বিশেষণ ও বিশেষ্য, (২) পূর্ব ও পর উভয় পদই বিশেষ্য, (৩) পূর্ব ও পরপদ বিশেষণ ও বিশেষণ, (৪) পর-পদের অর্থপ্রাধান্য, (৫) এমন সমাসনিষ্পন্ন পদ এক ব্যক্তি বা বস্তু হলে কর্মধারয় হয়।
❏ পূর্বপদ ও পরপদ যথাক্রমে বিশেষণ ও বিশেষ্য: শ্বেত যে পদ্ম = শ্বেতপদ্ম, কানা যে কড়ি = কানাকড়ি, মহৎ যে জন = মহাজন, মহৎ যে বল = মহাবল, মহান রে রাজা = মহারাজা [মহৎ, মহান স্থানে মহা হয়। কিন্তু মহৎ যে ভয়= মহয়। কু (খারাপ) যে শাসন = কুশাসন, কড়া যে পাক = কড়াপাক, পূর্ণ যে চন্দ্র = পূর্ণচন্দ্র, ছিন্ন যে বস্ত্র = ছিন্নবস্ত্র, ইষ্ট যে দেবতা = ইষ্টদেবতা, রাম (বড়ো) যে ছাগল = রামছাগল, মণ্ডল যে আকার = মণ্ডলাকার, হেঁড়ে যে গলা = হেঁড়ে গলা । একরম-পুণ্যভূমি, নবান্ন, লালফুল, হেডপণ্ডিত, কালোপেঁচা, খাসমহল, বদমেজাজ, বদহজম, নবযৌবন ইত্যাদি। কর্মধারয় সমাসে কতকগুলি পদের যে ক্ষেত্রে পূর্ব-নিপাত হয়, অর্থাৎ সমাসনিষ্পন্ন হওয়ার পর ব্যাসবাক্যের পূর্বপদ পরপদের পরে বসে। যেমন – সিদ্ধ যে আলু = আলুসিদ্ধ, বাটা যে হলুদ = হলুদবাটা, ভাজা যে চাল = চালভাজা। এরকম—রাজাধম, নরোত্তম, পুরুষোত্তম, জনসাধারণ, চা-গরম, তেলপড়া, মাছভাজা, বেগুনপোড়া ইত্যাদি।
❏ পূর্ব ও পর উভয় পদ বিশেষ্য : যিনি রাজা তিনিই ঋষি = রাজর্ষি, যিনি মা তিনিই সরস্বতী = মা সরস্বতী, যিনি সম্রাট তিনিই কবি = সম্রাটকবি। এরকম- দাদাঠাকুর, রাজাবাদশা, লাটসাহেব, পিতাঠাকুর, দাদামশাই ইত্যাদি।
❏ পূর্ব ও পর উভয় পদ বিশেষণ : যাহা সহজ তাহাই সরল = সহজসরল, কাঁচা অথচ মিঠা = কাঁচামিঠা, অম্ল অথচ মধুর = অম্লমধুর, অগ্রে সুপ্ত পশ্চাৎ উত্থিত = সুপ্তোত্থিত। এরকম— কঠোরকোমল, পণ্ডিতমূর্খ, মিঠেকড়া, নীললোহিত,হিংস্রকুটিল, করুণকোমল, ফিকেলাল, কাঁচাপাকা, সাদাসিধে, দীনহীন, শান্তশিষ্ট, দীনদুঃখী, লালকালো, পূতপবিত্র, শীতোষ্ণ, জীবত, সুস্থসবল, কানাখোঁড়া, মধুরশ্যামল, লম্বাচওড়া ইত্যাদি।
👇 জেনে রাখো :
কর্মধারয় সমাসের বিষয়টি অনেকে দ্বন্দ্ব সমাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। দ্বন্দ্ব সমাসে পূর্ব ও পর উভয় পদের বস্তু, বিষয় বা ব্যক্তি যাই হোক না কেন তা হয় পৃথক এবং উভয় পদের সমান অর্থপ্রাধান্য থাকে। যেমন – কর্ণার্জুন। কর্ণ ও অর্জুন দুই পৃথক ব্যক্তি এবং সমাসনিষ্পন্ন হওয়ার পরেও উভয়ের সমান প্রাধান্য। অপরপক্ষে, উভয় পদ বিশেষ্য কিংবা বিশেষণযুক্ত কর্মধারয় সমাসে একই বস্তু, বিষয় বা ব্যক্তির অবস্থা বা গুণগত রূপ দেখানো হয় এবং সকল ক্ষেত্রে পরপদের অর্থ প্রধান হয়। যেমন—রাজর্ষি, কাঁচামিঠা প্রভৃতি। যিনি রাজা তিনি ঋষি (অর্থাৎ একই লোক), কাঁচা অথচ মিঠা (যে বস্তুই হোক না কেন, তা একটি)।
❏ উপমান, উপমিত ও রূপক কর্মধারয় :
এই তিন সমাস উপমেয়, উপমান ও এদের সাধারণ ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত হয়। এজন্য এই তিন সমাসের আলোচনা করার আগে উপমেয়, উপমান ও এদের সাধারণ ধর্মের সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়োজন আছে।
👇 জেনে রাখো :
যার তুলনা করা হয়, তা হলো উপমেয়। যার সঙ্গে তুলনা করা হয় তা হলো উপমান এবং উপমেয় ও উপমান উভয়ের যেধর্মগতবা গুণগত মিলতা হলো সাধারণ ধর্ম। দুধের মতো সাদা জোছনায় চারদিক ভেসে গেছে। 'জোছনা' তুলনার বিষয়, সুতরাংউপমেয়। 'দুধ'-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, সুতরাং উপমান। ‘দুধ’আর‘জোছনা বিজাতীয় বস্তু কিন্তু গুণগত দিক থেকে একটাজায়গায় উভয়েরমিল আছে। দুধও সাদা, জোছনাও সাদা। সুতরাং ‘সাদা’সাধারণ ধর্ম।
❏ উপমান কর্মধারয় : উপমানবাচক পূর্বপদের সঙ্গে সাধারণ ধর্মবাচক পরপদের সমাস হলে, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। লক্ষণীয় যে, উপমানবাচক পূর্বপদ হয় বিশেষ্য এবং সাধরণ ধর্মবাচক পরপদ হয় বিশেষণ। যেমন—শশের ন্যায় ব্যস্ত = শশব্যস্ত। শশ' উপমান ও বিশেষ্য পদ, 'ব্যস্ত' সাধারণ ধর্ম ও বিশেষণ পদ।
কাজলের ন্যায় কালো = কাজলকালো, তুষারের ন্যায় শুভ্র = তুষারশুভ্র, জলদের ন্যায় গম্ভীর = জলদগম্ভীর, অমৃতের ন্যায় মধুর = অমৃতমধুর, মসীর ন্যায় কৃষ্ণ = মসীকৃষ্ণ, ফুটির মতো ফাটা = ফুটিফাটা, ঘনের ন্যায় শ্যাম = ঘনশ্যাম, বরফের মতো সাদা = বরফসাদা, আপেলের মতো রাঙা = আপেলরাঙা, পান্নার মতো সবুজ = পান্নাসবুজ, নবনীর ন্যায় কোমল = নবনীকোমল। এরকম- -রক্তরাঙা, তুষারশীতল, সিঁদুররাঙা, কুন্দশ্রুভ্র, হস্তীমূর্খ, চিঁড়েচ্যাপটা, হরিণচপল, গোবেচারা, মিশকালো, ভ্রমরকৃষ্ণ ইত্যাদি।
⚡এখানে লক্ষ করো : (১) পূর্বপদ উপমানবাচক, (২) পরপদ সাধারণ ধর্মবাচক, (৩) উভয় পদের মধ্যে সমাস, (৪) সমাসনিষ্পন্ন পদে পরপদের অর্থপ্রাধান্য।
❏ উপমিত কর্মধারয় : উপমেয়বাচক পূর্বপদের সঙ্গে উপমানবাচক পরপদের সমাস হলে, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। লক্ষণীয় যে, সাধারণ ধর্মবাচক শব্দের উল্লেখ না থাকলেও সমাসের মধ্যে সাধারণ ধর্মের অর্থ আভাসিত হয়। পূর্ব ও পর উভয় পদ হয় বিশেষ্য। যেমন- চরণ কমলের ন্যায় = চরণকমল। এতে চরণ’ও ‘কমল’ যথাক্রমে উপমেয় ও উপমানবাচক বিশেষ্য পদ। মুখ চন্দ্রের ন্যায় = মুখচন্দ্র, অধর কিশলয়ের ন্যায় = অধরকিশলয়, লোচন পলাশের ন্যায় = লোচন পলাশ, পুরুষ সিংহের ন্যায় = পুরুষসিংহ, আঁখি পদ্মের ন্যায় = আঁখিপদ্ম, কথা অমৃতের ন্যায় = কথামৃত, অধর পল্লবের ন্যায় = অধরপল্লব, কর পল্লবের ন্যায় = করপল্লব। এরকম – নরসিংহ, নয়নকমল ইত্যাদি।
⚡এখানে লক্ষ করো : (১) পূর্বপদ উপমেয়বাচক বিশেষ্য, (২) পরপদ উপমানবাচক বিশেষ্য, (৩) সমাসের মধ্যে সাধারণ ধর্মের অর্থ আভাসিত হয়, (৪) সমাসনিষ্পন্ন পদে পরপদের অর্থপ্রাধান্য।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে পূর্বপদ ‘উপমান’, পরপদ ‘উপমেয়’হয়। যেমন—সিংহের ন্যায় শিশু = সিংহশিশু। এতে ‘সিংহ’ উপমান, ‘শিশু’উপমেয়। ‘বীরসিংহের সিংহশিশু’। ফটিক (স্ফটিক)-এর মতো জল = ফটিকজল, ওলের মতো কপি = ওলকপি, চাঁদের মতো মুখ = চাঁদমুখ। এরকম—ফুলবাবু, চন্দ্রপুলি, সোনামুখ, কদমছাঁট, দুধবরণ, টোপরপানা, শাঁখালু, আমসন্দেশ, পদ্মবেদি, কাঁচপোকা, চাঁদবদন, ফুলবড়ি প্রভৃতি।
⚡ব্যতিক্রম : (১) পূর্বপদ উপমানবাচক, (২) পরপদউপমেয়বাচক,(৩) উভয়ের মিলনে সমাসনিষ্পন্ন পদে পরপদের অর্থপ্রাধান্য।
❏ রূপক কর্মধারয় : উপমেয়বাচক পূর্বপদ ও উপমানবাচক পরপদের মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হলে, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। লক্ষণীয় যে, পূর্ব ও পরপদ বিশেষ্য হয়। যেমন—আঁখি রূপ পাখি = আঁখিপাখি। 'আঁখি' উপমেয়,‘পাখি’ উপমান, উভয়ের মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হয়েছে। ভব রূপ সিন্ধু = ভবসিন্ধু, বিষাদ রূপ সিন্ধু = বিষাদসিন্ধু, হৃদয় রূপ আকাশ = হৃদয়াকাশ, শোক রূপ অনল = শোকানল, রোষ রূপ অনল = রোষানল, মন রূপ মাঝি = মনমাঝি, সংসার রূপ চক্র = সংসারচক্র, ক্রোধরূপ বহ্নি = ক্রোধবহ্নি, কাল (মৃত্যু)রূপ বৈশাখী = কালবৈশাখী, প্রাণ রূপ পাখি = প্রাণপাখি, দেশ রূপ মাতৃকা = দেশমাতৃকা, প্রেমরূপ দরিয়া = প্রেমদরিয়া, চিত্তরূপ চকোর = চিত্তচকোর, সুখ রূপসায়র=সুখসায়র, মোহরূপ স্বপ্ন = মোহস্বপ্ন, কীর্তিরূপ ধ্বজা = কীর্তিধ্বজা, দিলরূপ দরিয়া = দিলদরিয়া, হৃদয় রূপ অরণ্য= হৃদয়ারণ্য, আশা রূপ লতা = আশালতা, জীবন রূপ তরি = জীবনতরি, যৌবন রূপ কুসুম = যৌবনকুসুম ইত্যাদি।
⚡এখানে লক্ষ করো : (১) পূর্বপদ উপমেয়বাচক, (২) পরপদ উপমানবাচক, (৩) পূর্ব ও পরপদের মধ্যে অভেদ কল্পনা, (৪) পরপদের অর্থপ্রাধান্য।
❏ মধ্যপদলোপী কর্মধারয় : যে কর্মধারয় সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যস্থিত পদ সমাসবদ্ধ পদে লোপ পায়, তাকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে। এতে পূর্ব ও পর উভয় পদ সাধারণত বিশেষ্য হয় এবং পূর্বপদ পরপদের বিশেষণ স্থানীয় হয়। যেমন—সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন। এতে ব্যাসবাক্যের মধ্যস্থিত “চিহ্নিত' পদটি সমাসবদ্ধ ‘সিংহাসন’ পদে লোপ পেয়েছে। সিংহ' ও ‘আসন’ উভয় পদ বিশেষ্য। পল (মাংস)মিশ্রিত অন্ন = পলান্ন, সিঁদুর রাখার কৌটা = সিঁদুরকৌটা, বিড়াল সদৃশ তপস্বী = বিড়ালতপস্বী, আক্কেলসূচক দাঁত = আক্কেল দাঁত, তেল মাখার ধুতি = তেলধুতি, স্টিমার বাঁধার ঘাট = স্টিমারঘাট, প্রদানকারী তরু = ছায়াতরু, স্বর্ণ নির্মিত অলংকার=স্বর্ণালংকার, বট নামক বৃক্ষ = বটবৃক্ষ, হাতে বাঁধার ঘড়ি = হাতঘড়ি, ঘি মেশানো ভাত = ঘিভাত, ঘরে আশ্রিত জামাই=ঘরজামাই, দাব জাত অনল = দাবানল, শাখাবিহারী মৃগ (পশু)= শাখামৃগ,
⚡এখানে লক্ষ করো : (১) পূর্ব ও পরপদ সাধারণত বিশেষ্য, (২) ব্যাস-বাক্যের মধ্যস্থিত পদ লোপ, (৩) পূর্বপদ পরপদের বিশেষণ স্থানীয়।
জীবন
[পূর্বপদ, বিশেষ্য]
আশঙ্কায়
[ মধ্যপদ]
বিমা
[পরপদ বিশেষ্য]
= জীবনবিমা
[ মধ্যপদ লোপ পেয়েছে]
আয়ের উপর কর = আয়কর, কেশে মাখার তৈল কেশতৈল, বউ পরিবেশিত ভাত=বউভাত, ভিক্ষা লব্ধ অন্ন = ভিক্ষান্ন, পানিতে (জলে) জন্মে যে ফল = পানিফল, শোক প্রকাশক সভা = শোকসভা, মুক্তা খচিত বলয় = মুক্তাবলয়, কনক নির্মিত মুকুট = কনকমুকুট, যজ্ঞ লব্ধ উপবীত = যজ্ঞোপবীত, মৌ সঞ্চয়কারী মাছি = মৌমাছি, রাজার অনুসৃত নীতি = রাজনীতি, পথে অনুষ্ঠিত সভা = পথসভা, বরের অনুগামী যাত্রী = বরযাত্রী, শববাহকদের যাত্রা = শবযাত্রা, ব্যোমে যাওয়ার যান = ব্যোমযান, জল মিশ্রিত সাগু = জলসাগু, জামাইয়ের কল্যাণার্থে ষষ্ঠী = জামাইষষ্ঠী, কুটিরজাত শিল্প = কুটিরশিল্প, আকাশ থেকে আগত বাণী = আকাশবাণী, ধর্ম রক্ষার জন্য ঘট = ধর্মঘট, অমৃতময় বাণী = অমৃতবাণী, চালে জন্মে যে কুমড়ো = চালকুমড়ো, নাতনিকে বিয়ে করেছে যে জামাই = নাতজামাই, বুদ্ধ প্রবর্তিত ধর্ম = বৌদ্ধধর্ম, পায়ে চালানো গাড়ি = পাগাড়ি, বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রী = বিদেশমন্ত্রী, অর্থ বিষয়ক মন্ত্রী = অর্থমন্ত্রী, মর্মর নির্মিত মূর্তি = মর্মরমূর্তি, ঋষির তুল্য কবি = ঋষিকবি, দেশের প্রতি অনুরাগ = দেশানুরাগ। এরকম লক্ষ্মীশ্রী (লক্ষ্মীজনিতা শ্রী), অষ্টাদশ (অষ্ট অধিক দশ), দ্বাদশ (দ্বি অধিক দশ), ষোড়শ (যট অধিক দশ), পাষাণহৃদয়, প্রলয়লোলুপ (প্রলয় ঘটাবার জন্য লোলুপ), পাথরবাটি, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি ।
③ তৎপুরুষ সমাস : যে সমাসে পূর্বপদে কর্ম, করণ, অপাদান প্রভৃতির বিভক্তি লোপ পায় এবং পরপদের অর্থপ্রাধান্য থাকে, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন—গাছে পাকা = গাছপাকা। এতে পূর্বপদ ‘গাছে’ ও পরপদ ‘পাকা'। সমাসনিষ্পন্ন হওয়ার পর পূর্বপদের অধিকরণে ‘এ’ বিভক্তি লোপ পেয়েছে এবং পরপদের অর্থপ্রাধান্য ঘটেছে। [ ‘তৎপুরুষ’–সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস, ব্যাসবাক্য : তৎ(তস্য = তার) পুরুষ।] পূর্বপদের কর্ম,করণ ইত্যাদি। বিভক্তি অনুসারে তৎপুরুষ সমাস ছয় প্রকার—কর্ম তৎপুরুষ, করণ তৎপুরুষ, অপাদান তৎপুরুষ, সম্বন্ধ তৎপুরুষ, অধিকরণ তৎপুরুষ ও নিমিত্ত তৎপুরুষ। তা ছাড়া আছে উপপদ তৎপুরুষ, ব্যাপ্তি তৎপুরুষ, ক্রিয়াবিশেষণ তৎপুরুষ ও উপসর্গ তৎপুরুষ।
⚡এখানে লক্ষ করো : (১) পূর্বপদ কর্ম, করণ ইত্যাদি বিভক্তি বা বিভক্তি হিসেবে ব্যবহৃত অনুসর্গ শোভিত পদ; (২) সমাসনিষ্পন্ন হলে বিভক্তি বা বিভক্তি স্থানীয় অনুসর্গের লোপ, (৩) পরপদের অর্থ- প্রাধান্য, এমন সমাস তৎপুরুষ।
❏ কর্ম তৎপুরুষ : যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে কর্মের বিভক্তি 'কে' লোপ পায় তাকে কর্ম তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন—বাসনকে মাজা = বাসনমাজা, লোককে দেখানো = লোকদেখানো, সাহিত্যকে সম্ভোগ = সাহিত্যসম্ভোগ, রথকে দেখা = রথদেখা। এরকম — বীজ-বোনা, গা-ঢাকা, পকেট-মার, সাপ-খেলানো, তেষ্টা পাওয়া, কাপড়-কাচা ইত্যাদি। আশ্রিত,প্রাপ্ত,আপন্ন,অতীত, আগত ইত্যাদি শব্দের যোগেও কর্ম তৎপুরুষ হয়। যেমন—গঙ্গাকে প্রাপ্ত = গঙ্গাপ্ৰাপ্ত, চরণকে আশ্রিত = চরণাশ্রিত, দেবকে আশ্রিত = দেবাশ্রিত, সাহায্যকে প্রাপ্ত = সাহায্যপ্রাপ্ত, বয়ঃকে প্রাপ্ত = বয়ঃপ্রাপ্ত, বিপদকে আপন্ন = বিপদাপন্ন, শরণকে আগত = শরণাগত, স্মরণকে অতীত = স্মরণাতীত ইত্যাদি।
❏ করণ তৎপুরুষ: যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে করণের জন্য বিভক্তিরূপে ব্যবহৃত ‘দিয়া”, “দ্বারা” ইত্যাদি লোপ পায়, তাকে করণ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন- রোগ দ্বারা শীর্ণ = রোগশীর্ণ, রোগ দ্বারা জীর্ণ = রোগজীর্ণ, ঢেঁকি দ্বারা ছাঁটা = ঢেঁকিছাঁটা, ধুলি দ্বারা ধূসর = ধূলিধূসর, গোঁজা দ্বারা মিল = গোঁজামিল, ছায়া দ্বারা ঘেরা = ছায়াঘেরা, ঘৃতদ্বারা পক্ক = ঘৃতপক্ক, যন্ত্র দ্বারা চালিত = যন্ত্রচালিত, স্নান দ্বারা সিক্ত = স্নানসিক্ত। এরকম – সপর্দষ্ট, জুতোপেটা, বাদুড়চোষা, মনগড়া, জরাজীর্ণ, নামাঙ্কিত, পদাঘাত, বাগদত্তা (বাদ্বারা দত্তা), কীটদষ্ট, রৌদ্রদীপ্ত, পরীক্ষালব্ধ ইত্যাদি।
হীন, রহিত, শূন্য ইত্যাদি ঊনার্থক শব্দ পরপদরূপে ব্যবহৃত হলেও করণ তৎপুরুষ হয়। যেমন—শ্রী দ্বারা হীন = শ্রীহীন, বুদ্ধি দ্বারা হীন = বুদ্ধিহীন, সঙ্গী দ্বারা হীন = সঙ্গীহীন, গণ্ডি দ্বারা হীন = গণ্ডিহীন, বিদ্যা দ্বারা হীন = বিদ্যাহীন, জ্ঞান দ্বারা শূন্য = জ্ঞানশূন্য, তৃণ দ্বারা শূন্য = তৃণশূন্য, জ্ঞান দ্বারা রহিত = জ্ঞানরহিত। এরকম—পুত্রহীন, রাজ্যহীন ইত্যাদি। যুক্ত, অন্বিত, বিশিষ্ট ইত্যাদি যুক্তার্থক শব্দ পরপদরূপে ব্যবহৃত হলেও করণ তৎপুরুষ হয়। যেমন—যুক্তি দ্বারা যুক্ত = যুক্তিযুক্ত, চিন্তা দ্বারা অন্বিতা = চিন্তান্বিতা, বিস্ময় দ্বারা অন্বিত = বিস্ময়ান্বিত, জ্ঞান দ্বারা বিশিষ্ট = জ্ঞানবিশিষ্ট ইত্যাদি।
❏ নির্মিত তৎপুরুষ : যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে বিভক্তিরূপে যুক্ত 'নিমিত্ত', 'জন্য', ‘উদ্দেশ্য” ইত্যাদি নিমিত্তার্থক শব্দ লোপ পায়, তাকে নিমিত্ত তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন—যুপের নিমিত্ত কাষ্ঠ = যূপকাষ্ঠ, লোকের নিমিত্ত হিত = লোকহিত, শয়নের নিমিত্ত কক্ষ = শয়নকক্ষ, বিয়ের জন্য পাগলা = বিয়ে পাগলা, বালিকাদের জন্য বিদ্যালয় বালিকা-বিদ্যালয়, মড়ার জন্য কান্না = মড়াকান্না, রান্নার নিমিত্ত ঘর = রান্নাঘর, ক্রীড়ার নিমিত্ত শৈল = ক্রীড়াশৈল, অনাথের জন্য আশ্রম = অনাথ-আশ্রম, স্মৃতির উদ্দেশ্যে মন্দির = স্মৃতি-মন্দির। এরকম – স্নানযাত্রা, ভিক্ষা-ঝুলি, ছাত্রাবাস, দেবমন্দির, রাজকর, সংবাদপত্র, পুত্রশোক, স্বাস্থ্যবিভাগ, তীর্থযাত্রা, জিয়নকাঠি, শিশুসাহিত্য, মাগ্গিভাতা (মাগ্গি >মহার্ঘ-র জন্য ভাতা), রঙ্গমঞ্চ, মুক্তিসংগ্রাম, পান্থনিবাস, ফাঁসিকাঠ, ডাকঘর, শান্তিনিকেতন, চণ্ডীমণ্ডপ, খাদ্য-আন্দোলন, ডাকমাশুল, সত্যাগ্রহ, বিশ্রামকক্ষ, মাপকাঠি, অতিথিশালা, ঠাকুরঘর, পাটখেত, খেয়াজাহাজ, খেয়াঘাট ইত্যাদি।
❏ অপাদান তৎপুরুষ : যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে অপাদানের জন্য বিভক্তিরূপে ব্যবহৃত 'হইতে', 'থেকে' ইত্যাদি লোপ পায়, তাকে অপাদান বা অপায় তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন—অগ্নি থেকে ভয় = অগ্নিভয়, সত্য থেকে ভ্রষ্ট = সত্যভ্রষ্ট, লোক থেকে লজ্জা = লোকলজ্জা, আদি থেকে অন্ত = আদ্যন্ত, বন্ধন থেকে মুক্তি = বন্ধনমুক্তি, বিলাত থেকে ফেরত = বিলাতফেরত, দল থেকে ছাড়া = দলছাড়া, তৎ (সং) থেকে ভব (জাত) =তদ্ভব। এরকম—রাজ্যচ্যুত, যুদ্ধোত্তর, রোগমুক্ত, শাপমুক্ত, ঘোষজা (ঘোষ বংশ থেকে জাত), মিত্তিরজা, সর্পভয়, বিদেশাগত, ঋণমুক্তি, কর্মবিরতি, ইস্কুলপালানো, গ্রামছাড়া, সৃষ্টিছাড়া, বিশ-পঁচিশ, জেলখালাস, জলাতঙ্ক (জল থেকে আতঙ্ক), মৃত্যুভয়, দুগ্ধজাত, ব্যাঘ্রভয় ইত্যাদি।
❏ সম্বন্ধ তৎপুরুষ : যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে সম্বন্ধ বিভক্তি ‘র', 'এর' ইত্যাদি লোপ পায়, তাকে সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন—কণ্টকের মুকুট = কণ্টকমুকুট, বিশ্বের স্রষ্টা = বিশ্বস্রষ্টা, জলের পিপাসা = জলপিপাসা, শবের দাহ = শবদাহ, প্রজার পালক = প্রজাপালক, অর্থের লিপ্সা = অর্থলিপ্সা, গঙ্গার জল = গঙ্গাজল, পথের রাজা = রাজপথ, ছাগীর দুগ্ধ = ছাগদুগ্ধ, হংসের রাজা = রাজহংস, নদীর মাঝ = মাঝনদী, দরিয়ার মাঝ = মাঝদরিয়া, বৌদ্ধদের ধর্ম = বৌদ্ধধর্ম, কালীর দাস = কালিদাস পূর্বপদের'ঈ'-কার ই-কার হয়। অনুরূপ – ষষ্ঠি দাস, দেবিদাস ; অবশ্য চণ্ডিদাস ও চণ্ডীদাস দুই-ই হয়।
‘কালীপদ’,‘দেবীপদ’ঈ-কার হয়।), সোদরের প্রতিম = সোদরপ্রতিম, কটাক্ষের পাত = কটাক্ষপাত, পরীক্ষার অর্থী (যাচক)= পরীক্ষার্থী, ভ্রাতার তুল্য = ভ্রাতৃতুল্য, নক্ষত্রের বেগে = নক্ষত্রবেগে, দেবের আলয় = দেবালয়, স্বর্ণের মুদ্রা = স্বর্ণমুদ্রা, জীবনের ইতিহাস = জীবন-ইতিহাস, স্বর্গের পথ = স্বর্গপথ, কমলের কানন = কমলকানন, দানের সামগ্রী = দানসামগ্রী, দস্যুর দল = দস্যুদল, দলের পতি = দলপতি, পদের ধূলি = পদধূলি, মানবের শিশু = মানবশিশু, নামের কীর্তন=নামকীর্তন, মাতার বৎসল = মাতৃবৎসল, মার (লক্ষ্মীর) ধব (স্বামী) = মাধব, কাষ্ঠের ভার = কাষ্ঠভার, স্বর্গের উদ্যান = স্বর্গোদ্যান, শ্রী (লক্ষ্মীর) ঈশ (পতি) = শ্রীশ, বিশ্বের মিত্র = বিশ্বামিত্র, বোধের উদয় = বোধোদয়, বৃক্ষের রাজি = বৃক্ষরাজি, ভ্রাতার গণ = ভ্রাতৃগণ, ধনীর গণ = ধনীগণ। এরকম—কবিগুরু, অঞ্চলপরিষদ, গ্রামসভা, ব্লক-অফিস, গণতন্ত্র, রাজবৈদ্য, হংসডিম্ব (হংসীর ডিম্ব), সৎসঙ্গ, পুষ্পরাশি, বনফুল, দেশপ্রান্ত, দেশবন্ধু, রাজপুত্র, রাজকুমারী, জনকল্যাণ ইত্যাদি।
❏ অধিকরণ তৎপুরুষ : যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে অধিকরণের বিভক্তি ‘এ’, ‘য়' ইত্যাদি লোপ পায়, তাকে অধিকরণ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন—অকালে মৃত্যু = অকালমৃত্যু, গৃহে আগত = গৃহাগত, গোলায় ভরা = গোলাভরা, কোণে ঠাসা = কোণঠাসা; গাছে পাকা = গাছপাকা, রাতে কানা = রাতকানা, জগতে বিখ্যাত = জগদ্বিখ্যাত, লোকে বিখ্যাত = লোকবিখ্যাত, মনে মরা = মনমরা, রোদনের প্রবণতা = রোদন প্রবণতা, কণ্ঠে আগত = কণ্ঠাগত, তর্কে পটু = তর্কপটু, সভায় আসীন = সভাসীন, পাঠে অনুরাগী = পাঠানুরাগী, সাহিত্যে প্রীতি = সাহিত্যপ্রীতি, অকালে বোধন = অকালবোধন। এরকম—জলমগ্ন, বনবাস, পানাসক্ত (পানে আসক্ত), ক্রীড়াকুশল, গৃহবাস, মহাকাশভ্রমণ ইত্যাদি।
পূর্বপদের পরনিপাত : পূর্বে অশ্ৰুত = অশ্রুতপূর্ব, পূর্বে ভূত = ভূতপূর্ব, পূর্বে অভূত = অভূতপূর্ব, পূর্বে অদৃষ্ট = অদৃষ্টপূর্ব, পূর্বে আস্বাদিত = আস্বাদিতপূর্ব, পূর্বে শ্রুত = শ্রুতপূর্ব ইত্যাদি।
❏ না-তৎপুরুষ : পূর্বপদের না’, ‘নয়’, ‘নাই' ইত্যাদি নঞর্থক বা নিষেধার্থক অব্যয় হলে এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য থাকলে, এরকম তৎপুরুষ সমাসকে না-তৎপুরুষ বা নঞ তৎপুরুষ সমাস বলে। পরপদের প্রথম বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ হলে ‘নয়’ স্থানে ‘অ’ হয়। যেমন—নয় চেনা = অচেনা, নয় সম্মত = অসম্মত, নয় বিধেয় = অবিধেয়, নয় কাজ = অকাজ, নয় সুস্থ = অসুস্থ, এরকম – অকপট, অকাতর, অব্রাহ্মণ, অধর্ম, অমিল ইত্যাদি। পরপদের প্রথম বর্ণ স্বরবর্ণ হলে ‘নয়’স্থানে অন্ হয়। যেমন—নয় আবৃত = অনাবৃত, নয় উচিত = অনুচিত, নয় উদার = অনুদার, নয় আবাদি = অনাবাদি, নয় অশন = অনশন, নয় অন্য = অনন্য, নয় ঐক্য = অনৈক্য, নয় অন্ত = অনন্ত, নয় আহার = অনাহার, নয় এক = অনেক, নয় অধিকৃত = অনধিকৃত, নয় আহুত = অনাহুত ইত্যাদি।
আবার কখনো-কখনো পরপদের প্রথম বর্ণ স্বরবর্ণ হলে 'নয়' স্থানে ‘ন’হয়। যেমন—নয় অতি দীর্ঘ = নাতিদীর্ঘ, নয় অতি বৃহৎ = নাতিবৃহৎ ইত্যাদি। তা ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘না’ স্থানে ‘অনা’, ‘না', ‘আ’,‘গর’,‘বি’,‘বে’,‘নি’,‘নির্’ ইত্যাদি হয়। যেমন—
- অনা : নয় আঘাত = অনাঘ্রাত, নয় সৃষ্টি = অনাসৃষ্টি (অনাছিষ্টি), নয় আবিষ্কৃত = অনাবিষ্কৃত ইত্যাদি।
- না : নয় মঞ্জুর = না-মঞ্জুর, নেই দাবি = না-দাবি, নয় জানা = না-জানা। এরকম নাবালক, না-দেখা ইত্যাদি।
- আ : নয় কাচা = আকাচা, নয় কাল = আকাল, নয় লুনি = আলুনি, নয় ছোলা = আছোলা ইত্যাদি।
- গর: নয় মিল (না মিল) = গরমিল, নয় হাজির = গরহাজির ইত্যাদি।
- বি: নয় সদৃশ = বিসদৃশ, নেই জোড় = বিজোড়, নেই ভুঁই = বিভুঁই, নয় পথ = বিপথ, নয় দেশ = বিদেশ ইত্যাদি।
- বে : নয় রসিক = বেরসিক, নয় ঠিক = বেঠিক, নেই সামাল = বেসামাল, নেই পরোয়া = বেপরোয়া ইত্যাদি।
- নি, নির্; নেই আশা = নিরাশা, নেই ঊন = ন্যূন (নি-ঊন), নেই খরচ = নিখরচা, নেই খুঁত = নিখুঁত ইত্যাদি।
❏ উপপদ তৎপুরুষ : উপপদের সঙ্গে কৃদন্ত পদের মিলনে যে সমাস হয়, তাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে।
👇 জেনে রাখো : কৃদন্ত পদ : ধাতুর উত্তর যে প্রত্যয় হয়, তা কৃৎ-প্রত্যয়। কৃৎ-প্রত্যয়ান্ত পদ কৃদন্ত পদ।
উপপদ : কৃদন্ত পদের পূর্ববর্তী পদ হলো উপপদ। যেমন ইন্দ্রজিৎ। 'জিৎ' (জি + ক্বিপ্) হলো কৃদন্ত পদ এবং ‘জিৎ'-এর পূর্ববর্তী ‘ইন্দ্ৰ’ হলো উপপদ।
যেমন—অগ্রে জন্মে যে = অগ্রজ, জলে চরে যে = জলচর, গ্রামে বাস করে যে = গ্রামবাসী, বর্ণ চুরি করে যে = বর্ণচোরা, মধু পান করে যে = মধুপ, পঙ্কে জন্মে যা = পঙ্কজ, দুঃখে থাকে যে = দুস্থ, পরম তপ দমন করে যে = পরম্ভপ, শত্রুকে হত্যা করে যে = শত্রুঘ্ন, গিরিতে শয়ন করেন যিনি= গিরিশ, রাজ্য পালন করেন যিনি = রাজ্যপাল, ছেলে ধরে যে= ছেলেধরা, পকেট মারে যে = পকেটমার, নিকটে থাকে যা = নিকটস্থ, গো (গোরুকে) পালন করে যে = গোপ, জল দেয় যে = জলদ, কুম্ভ করে যে = কুম্ভকার, সর্ব জানেন যিনি = সর্বজ্ঞ, শুভ দেয় যে = শুভদ, শ্রম দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে যে = শ্রমজীবী, বিশ্বকে গ্রাস করে যে = বিশ্বগ্রাসী, নাড়ি টেপে যে = নাড়ি-টেপা, দুঃ (দুঃখে) সহ (সহ্য করা) যায় যা = দুঃসহ, অভ্যন্তরে স্থিত যে = অভ্যন্তরস্থ, নরকে গমন করে যে = নরকগামী, জল ধারণ করে যে = জলধর, লক্ষ্য হারায়েছে যে = লক্ষ্যহারা।
বসুকে ধারণ করেন যিনি (স্ত্রী)= বসুধা, পরান হরণ করেন যিনি= পরানহরণী, মালা করে যে = মালাকার, কাঠ ঠোকরায় যে = কাঠঠোকরা, পাগল করে যে = পাগল-করা, পেশ করে যে = পেশকার, পথ করেন যিনি = পথিকৃৎ, বার্তা বহন করে যে = বার্তাবহ। এরকম—হাত ধরা, লোক-ঠকানো, নীরদ, জলজ, মনোজ, পাড়া-বেড়ানি, ভুঁইফোঁড়, পা-চাটা, বাস্তুহারা, শ্লোক-বলা, একান্নবর্তী (একান্ন বর্তন করে যে), দিশাহারা, মর্মদাহী, বরদ, ভবঘুরে, মাছিমারা, ফেল-মারা, সব্যসাচী (সব্য (বাম ও দক্ষিণ) হস্ত সচন করেন যিনি], সর্বহারা (সর্বহারায়েছে যে), দ্বিপ [(শুন্ড ও মুখ) দ্বারা পান করে যে], সেনানী [সৈন্যদলকে নেয় (নেতৃত্ব) দেয় যে], হরিণ (হরণ করে যে) ইত্যাদি।
❏ ব্যাপ্তি তৎপুরুষ: ‘ব্যাপ্তি' বোঝাতে সংস্কৃতে দ্বিতীয়া বিভক্তি আছে, সেজন্য সংস্কৃতে ‘ব্যাপ্তি' অর্থে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ হয়। যেমন—মুহূৰ্ত্তম সুখম্—মুহূর্ত্তসুখম্ (মুহূর্ত কালব্যাপী সুখ)।‘ব্যাপ্তি’অর্থ বোঝাতে বাংলায় সংস্কৃতের মতো পৃথক দ্বিতীয়া বিভক্তি নেই। সেজন্য ‘ব্যাপ্তি' অর্থপ্রকাশক সমাস কর্ম তৎপুরুষের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে পৃথক ‘ব্যাপ্তি তৎপুরুষ' হওয়া যুক্তিযুক্ত। যে তৎপুরুষ সমাসে 'ব্যাপ্তি' অর্থ প্রকাশিত হয়, তাকে বলা হয় ব্যাপ্তি তৎপুরুষ সমাস। যেমন— পাদ থেকে মস্তক পর্যন্ত = আপাদমস্তক, সমুদ্র থেকে হিমাচল পর্যন্ত = আসমুদ্রহিমাচল, আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত = আদ্যন্ত, কন্ঠ পর্যন্ত = আকণ্ঠ, জীবন পর্যন্ত = আজীবন, ক্ষণকালব্যাপী স্থায়ী = ক্ষণস্থায়ী, চিরকালব্যাপী সুখ = চিরসুখ। এরকম—আশৈশব, আগাগোড়া, আমরণ, আজন্ম, মুহূর্তসুখ, মাসাশৌচ, চিরবসন্ত, চিরস্মরণীয়, চিরশত্রু, জীবনানন্দ, চিরকৃতজ্ঞ, চিরচঞল, দীর্ঘস্থায়ী, নিত্যানন্দ, চিরস্থায়ী, দীর্ঘজীবন ইত্যাদি।
❏ ক্রিয়াবিশেষণ তৎপুরুষ : ক্রিয়াবিশেষণ বোঝাতে সংস্কৃতে দ্বিতীয়া বিভক্তি হয়। পূর্বপদ ক্রিয়াবিশেষণ হলে সংস্কৃতে সেই সমাসকে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ বলা হয়। যেমন—অর্থং সমাপ্তঃ – অর্ধসমাপ্তঃ (অর্ধভাবে সমাপ্ত)। বাংলায় ক্রিয়াবিশেষণের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিভক্তি নেই। সেজন্য পূর্বপদ ক্রিয়াবিশেষণ হলে এই ধরনের বাংলা সমাসকে 'ক্রিয়াবিশেষণ তৎপুরুষ' বলাই যুক্তিযুক্ত। যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদ ক্রিয়াবিশেষণ হয়, তাকে বলা হয় ক্রিয়াবিশেষণ তৎপুরুষ সমাস। যেমন—অর্ধভাবে স্ফুট = অর্ধস্ফুট, অর্ধভাবে মৃত = অর্ধমৃত, নিম (অর্ধ) ভাবে রাজি = নিমরাজি, আধ (অর্থ) ভাবে ময়লা = আধময়লা, আধ ( < অর্ধভাবে মরা = আধমরা ইত্যাদি।
❏ উপসর্গ তৎপুরুষ: যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদ উপসর্গের সঙ্গে পরপদ বিশেষ্য কিংবা বিশেষণের সমাস হয়, তাকে বলা হয় উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস। যেমন- বি (বিরুদ্ধা) মাতা = বিমাতা, মাত্রাকে অতিক্রম করে = অতিমাত্র, গর (অভাব) মিল = গরমিল। বাংলায় সংস্কৃত, বাংলা ও বিদেশি তিন ধরনের উপসর্গ আছে। উপসর্গ তৎপুরুষে পূর্বপদ যে-কোনো ধরনের উপসর্গ হতে পারে।
- পূর্বপদ সংস্কৃত উপসর্গ : প্র (পশ্চাদ্বর্তী) যে পৌত্র =প্রপৌত্র, প্র (প্রকৃষ্ট)দীপ্ত = প্রদীপ্ত, প্র (প্রকৃষ্ট) যে ভাত (জ্যোতি) = প্রভাত, প্রতি (প্রতিগত) যে অক্ষ (ইন্দ্রিয়) = প্রত্যক্ষ, প্রতি (প্রতিগত) যে শব্দ = প্রতিশব্দ, মানবকে অতিক্রম করে = অতিমানব, প্রতি (বিরুদ্ধ) যে পক্ষ = প্রতিপক্ষ ইত্যাদি।
- পূর্বপদ বাংলা উপসর্গ : ভর (ভরা/পূর্ণ) সন্ধ্যা = ভরসন্ধ্যা, রাম (বৃহৎ) যে দা = রামদা ইত্যাদি।
- পূর্বপদ বিদেশি উপসর্গ : বদ (খারাপ/নিন্দা) নাম = বদনাম, ফি (প্রতি) বছর = ফি-বছর, গর (অভাব) হাজির = গরহাজির, বে (অভাব) হিসাব = বেহিসাব ইত্যাদি।
④ বহুব্রীহি সমাস : যে সমাসে সমস্যমানপদের অর্থ প্রতীয়মান না হয়ে তাদের দ্বারা লক্ষিত অন্য কোনো অর্থ প্রকাশিত হয়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন—দশ আনন যাঁর = দশানন। এতে ‘দশ’ও ‘আনন' সমস্যমানপদ। সমাসনিষ্পন্ন হওয়ার পর ‘দশ’ও ‘আননের’অর্থপ্রকাশিত না হয়ে ওই দুই পদের দ্বারা লক্ষিত ‘দশানন' শব্দের অর্থ‘রাবণ’প্রকাশিত হয়েছে। অনুরূপ-ত্রি লোচন যাঁর = ত্রিলোচন (মহাদেব), পীত অম্বর যায় = পীতাম্বর (শ্রীকৃষ্ণ), চন্দ্র শেখরে আছে যাঁর = চন্দ্রশেখর (মহাদেব)। বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ বিশেষ্য, বিশেষণ, এমনকি সংখ্যাবাচক বিশেষণ হতে পারে। যেমন—ওপরের দৃষ্টান্তগুলিতে চন্দ্ৰ (বিশেষ্য), পীত (বিশেষণ), ত্রি (সংখ্যাবাচক বিশেষণ)। বহুব্রীহি সমাসনিষ্পন্ন পদ বিশেষ্য অথবা বিশেষণ হয়। ['বহুব্রীহি'– বহুব্রীহি সমাস; ব্যাসবাক্য : বহুব্রীহি (ধান্য) যাতে বা যার] ।
❏ মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি : যে বহুব্রীহি সমাসে ব্যাসবাক্যের মাঝের পদ লোপ পায়, তাকে মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন— পাঁচ সের পরিমাণ যার = পাঁচসেরি। এতে ব্যাসবাক্যের মাঝের পদ ‘পরিমাণ' লোপ পেয়েছে। এরকম— চাঁদের মতো সুন্দর মুখ যার = চাঁদমুখ, পদ্মের মতো সুন্দর মুখ যার (স্ত্রী) = পদ্মমুখী, সোনার মতো উজ্জ্বল মুখ যার (স্ত্রী)= সোনামুখী, কমলের ন্যায় সুন্দর লোচন যাঁর = কমললোচন, মুষলের মতো অতি স্থূল ধারার আকারে = মুষলধারে, স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল আভা যার = স্বর্ণাভ, আগুনের মতো উজ্জ্বল বরণ যার = আগুনবরণ, কম্বুর ধ্বনির মতো ধ্বনি যার = কম্বুধ্বনি। এরকম—বিম্বাধরা, এণাক্ষী [এণ (হরিণ)-এর অক্ষির মতো সুন্দর অক্ষি যারা, বিধুমুখী, কুম্ভকর্ণ, ক্ষুরধার, মেঘবরণ, হরিণনয়নী, বাঁদরমুখো ইত্যাদি।
👇 জেনে রাখো :
মধ্যপদলোপী বহুব্রীহিতে অনেক ক্ষেত্রে উপমানবাচক পদের সঙ্গে সমাস হয়, সেজন্য অনেকে এই জাতীয় সমাসকে উপমাত্মক বহুব্রীহি বলেছেন। মধ্যপদলোপী কর্মধারয়ের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো উভয় সমাসে ব্যাসবাক্যস্থ মধ্যপদের লোপ হলেও মধ্যপদলোপী কর্মধারয়ে পরপদের প্রাধান্য সূচিত হয়, অপরপক্ষে মধ্যপদলোপী বহুব্রীহিতে বহুব্রীহি সমাসের যে প্রধান বৈশিষ্ট্য (সমস্যমানপদের লক্ষিত অন্য অর্থ) তা প্রকাশিত হয়।
❏ ব্যতিহার বহুব্রীহি : যে বহুব্রীহি সমাসে একই শব্দের পুনরুত্তির দ্বারা পরস্পর একজাতীয় ক্রিয়া করা বোঝায়, তাকে ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন— লাঠিতে লাঠিতে যে যুদ্ধ = লাঠালাঠি, এতে 'লাঠি' শব্দের পুনরুক্তি হয়েছে। পূর্বপদের শেষে 'আ’ও পরপদের শেষে ‘ই’হয়েছে। এরকম— হাতে হাতে যে যুদ্ধ = হাতাহাতি, হাসিতে হাসিতে যে কাজ = হাসাহাসি, কোলে কোলে যে আলিঙ্গন = কোলাকুলি, ঘুসিতে ঘুসিতে যে যুদ্ধ = ঘুসোঘুসি, কানে কানে যে কথা = কানাকানি, কেশে কেশে আকর্ষণ করে যে লড়াই = কেশাকেশি। এরকম—দেখাদেখি, টানাটানি, মুষ্টামুষ্টি, ধস্তাধস্তি, জানাজানি, খুনোখুনি, মারামারি, ভাগাভাগি, গালাগালি, চুলোচুলি ইত্যাদি। কিন্তু শব্দের পুনরুক্তি হলেই ব্যতিহার বহুব্রীহি হয় না। পারস্পরিক ক্রিয়া-করণের অর্থ প্রকাশিত হওয়া চাই। যেমন—বাড়াবাড়ি, তাড়াতাড়ি, গড়াগড়ি, হাঁটাহাঁটি, সোজাসুজি, ঘোরাঘুরি প্রভৃতি ব্যতিহার বহুব্রীহি নয়, শব্দদ্বৈত।
❏ সহাৰ্থক বহুব্রীহি : বহুব্রীহি সমাসে 'সহিত' অর্থপ্রকাশক ‘সহ’শব্দের স্থানে ‘স’হয়। যে বহুব্রীহি সমাসে সহার্থক পূর্বপদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের সমাস হয়, তাকে সহার্থক বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন – বন্ধুসহ বর্তমান = সবান্ধব, বাকের সহিত বর্তমান = সবাক, শঙ্কার সহিত বর্তমান = সশঙ্ক, চরাচরের সহিত বর্তমান = সচরাচর, আকারসহ বর্তমান = সাকার, অবলীলার সহিত বর্তমান = সাবলীল, পরিবারসহ বর্তমান = সপরিবার। কিন্তু পরপদ বিশেষণ হলে সহার্থক বহুব্রীহি হয় না। যেমন- সকাতর, সশঙ্কিত, সানন্দিত, সলজ্জিত ইত্যাদি।
❏ না-বহুব্রীহি : যে বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদ নঞর্থক বা নিষেধার্থক অব্যয় হয়, তাকে না-বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন—নেই জ্ঞান যার = অজ্ঞান, নিজ্ঞান ; নেই ভুল যার = নির্ভুল, নেই বোধ যার= নির্বোধ, নেই সীমা যার = অসীম, নেই আদি যার = অনাদি, নেই কিঞ্চন যার = অকিঞ্চন, নেই খুঁত যার = নিখুঁত, নেই পুত্র যার = অপুত্রক, নেই হায়া যার = বেহায়া, নেই খোঁজ যার = নিখোঁজ, নেই শঙ্কা যার = নিঃশঙ্ক, নেই চেষ্টা যার = নিশ্চেষ্ট, নেই পদার্থ যার = অপদার্থ ইত্যাদি।
❏ সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি : যে বহুব্রীহি সমাসে সংখ্যাবাচক পূর্বপদের সঙ্গে পরপদ বিশেষ্যের সমাস হয়, তাকে বলা হয় সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস। যেমন – ত্রিনয়ন যার (স্ত্রী) = ত্রিনয়নী, সহস্র লোচন যার = সহস্রলোচন, পঞ্জ আনন যার = পঞ্চানন, দ্বি (দুই দিকে) অপ যার = দ্বীপ। এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেখা যায়। যেমন- দোফসলি, দোনলা, ষড়ানন, সাতরঙা ইত্যাদি। দ্বিগু সমাসে পূর্বপদ হয় সংখ্যাবাচক বিশেষণ। কিন্তু সেখানে পরপদের অর্থপ্রাধান্য ঘটে এবং সমাহার অর্থ প্রকাশিত হয়। বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ সংখ্যাবাচক বিশেষণ হলেও দ্বিগুর সঙ্গে বহুব্রীহির প্রধান পার্থক্য এই যে, এতে সমাহার অর্থ আদৌ প্রকাশিত হয় না, তা ছাড়া বহুব্রীহি সমাসের যে প্রধান বৈশিষ্ট্য (সমস্যমানপদের লক্ষিত অন্য অর্থ) তা দেখা যায়।
⑤ দ্বিগু সমাস : সংখ্যাবাচক বিশেষণ পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের সমাস হলে এবং সমাহার বা সমষ্টি অর্থ প্রকাশিত হলে, তাকে দ্বিগু সমাস বলে। এই সমাসে পরপদের অর্থপ্রাধান্য থাকে। যেমন–ত্রি ফলের সমাহার = ত্রিফলা। এতে পূর্বপদ ‘ত্রি’(তিন)সংখ্যাবাচক বিশেষণ, পরপদ ‘ফল’বিশেষ্য এবং ব্যাসবাক্যে ‘সমাহার' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।[ দ্বিগু—দ্বিগু সমাস ; ব্যাসবাক্য : দ্বি (দুই) গো (বিকারে'গো' স্থানে 'গু')। অর্থাৎ, দুই গোরুর সমষ্টি এই অর্থে ।] এক কড়ির বিনিময়ে কেনা = এককড়ি এটি তদ্ধিতার্থক দ্বিগু। এরকম—দুকড়ি, তিনকড়ি, পাঁচকড়ি, সাতকড়ি ইত্যাদি।
তদ্ধিতার্থক ও সমাহার—দুভাবে দ্বিগু সমাস হয়ে থাকে। সমাহার যোগে যে ব্যাসবাক্য হয়ে থাকে তা সমাহার দ্বিগু। যেমন—সপ্ত ঋষির সমাহার = সপ্তর্ষি, পঞ্চভূতের সমাহার = পঞ্চভূত, সপ্ত অহের সমাহার = সপ্তাহ, ত্রি মূর্তির সমাহার ত্রিমূর্তি, ত্রি কূটের সমাহার = ত্রিকূট, তে (তিন) মাথার সমাহার = তেমাথা, তে (তিন) সনের সমাহার = তে-সনি, শত অব্দের সমাহার = শতাব্দী, নব (নয়) রত্নের সমাহার = নবরত্ন, দু (দুই) পনের সমাহার = দু-পন, তে (তিন) পায়ের সমাহার = তে-পায়া, সে (সেহ্= তিন) তারের সমাহার = সেতার, পঞ্চবটের সমাহার = পঞ্চবটী। এরকম—নবগ্রহ, চৌরাস্তা, চারদিক, সপ্তপুরুষ, সপ্তরথী, শতবার্ষিকী, ত্রিজগৎ, ত্রিতাপ, ষড়রিপু, বারমাস্যা, দশচক্র, দুয়ানি, পাঁচফোড়ন, পশুরী [পন (পাঁচ) সেরের সমষ্টি], ত্রিযামা, পঞ্চনদ, চতুরঙ্গ, ষোড়শোপচার, ত্রিবেণী, অষ্টবসু, ত্রিভুজ, ত্রিপদী, চৌপদী, সপ্তপদী, তেরাত্তির, দোচালা, আটচালা, সাতকাণ্ড, অষ্টপ্রহর, শতবছর, ত্রিভুবন, সাতসমুদ্দুর, তেরোনদী, তেপান্তর ইত্যাদি।
⑥ অব্যয়ীভাব সমাস : যে সমাসে পূর্বপদ অব্যয় এবং পূর্বপদের অর্থই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। [ লক্ষণীয় যে, অব্যয়ীভাব সমাসে অনব্যয় পরপদ সমাসনিষ্পন্ন হওয়ার পর অব্যয়ভাবাপন্ন হয়। সেজন্য অব্যয়ীভাব বলা হয়। যেমন—ভাতের অভাব = হা -ভাত। এতে ‘হা’অব্যয় এবং এর অর্থই প্রধান হয়েছে। সীমা, ব্যাপ্তি, যোগ্যতা, সামীপ্য, অভাব, সাদৃশ্য, পশ্চাৎ, বীপ্সা, দূর-অভিমুখ, অনতিক্রম, বৈপরীত্য, ক্ষুদ্রতা ইত্যাদি অর্থে অব্যয়ীভাব সমাস হয়।
❏ সীমা ও ব্যাপ্তি: কৈশোর থেকে = আকৈশোর, জন্ম থেকে = আজন্ম, বাল্য থেকে = আবাল্য ইত্যাদি।
- যোগ্যতা : ধ্যানের যোগ্য = অনুধ্যান, কূলের যোগ্য = অনুকূল, ভাবের যোগ্য = অনুভাব ইত্যাদি।
- সামীপ্য : অক্ষির সমীপে = সমক্ষ, কূলের সমীপে = উপকূল, কণ্ঠের সমীপে = উপকণ্ঠ ইত্যাদি।
- অভাব : ঘরের অভাব = হা-ঘর, ভিক্ষার অভাব = দুর্ভিক্ষ, মিলের অভাব = গরমিল, আমিষের অভাব = নিরামিষ।
- সাদৃশ্য : ছবির সদৃশ = প্রতিচ্ছবি, দ্বীপের সদৃশ = উপদ্বীপ, নদীর সদৃশ = উপনদী, বনের সদৃশ = উপবন ইত্যাদি।
- পশ্চাৎ: তাপের পশ্চাৎ = অনুতাপ, গমনের পশ্চাৎ = অনুগমন, পদের পশ্চাৎ = অনুপদ ইত্যাদি।
- বীপ্সা : রোজ রোজ = হররোজ, ঘরে ঘরে = প্রতিঘর, ক্ষণে ক্ষণে = অনুক্ষণ, সন সন = ফি-সন ইত্যাদি।
- দূর ও অভিমুখ : অক্ষির পর (দূর) = পরোক্ষ, অক্ষির প্রতি (অভিমুখে) = প্রত্যক্ষ ইত্যাদি।
- অনতিক্রম : সাধ্যকে অতিক্রম না করে = যথাসাধ্য, শক্তিকে অতিক্রম না করে = যথাশক্তি ইত্যাদি।
- বৈপরীত্য : ফলের বিপরীত = প্রতিফল, হিংসার বিপরীত = প্রতিহিংসা, পক্ষের বিপরীত = প্রতিপক্ষ ইত্যাদি।
- আতিশয্য : পিত্যেশের (প্রত্যাশার) আতিশয্য = হাপিত্যেশ।
- সাকল্য : দ্বিজ চণ্ডাল সকলেই = আদ্বিজচণ্ডাল; বাল, বৃদ্ধ ও বনিতা সকলে = আবালবৃদ্ধবনিতা ইত্যাদি।
- ক্ষুদ্রতা : ক্ষুদ্র অঙ্গ = প্রত্যঙ্গ, ক্ষুদ্র গ্রহ = উপগ্রহ ইত্যাদি।
⑦ নিত্যসমাস (নিত্য সমাস কাকে বলে) : যে সমাসে সমস্যমান পদগুলি নিত্য বা সবসময় সমাসবদ্ধ থাকে অর্থাৎ, যার ব্যাসবাক্য হয় না, ব্যাসবাক্য করতে হলে একই অর্থবোধক অন্য কোনো পদের সাহায্য নিতে হয়, তাকে নিত্যসমাস বলে। যেমন—কৃষ্ণ সর্প = কৃয়সর্প। ব্যাসবাক্য ও সমাসবদ্ধ পদ এক। ব্যাসবাক্যের পদ সর্বদা সমাসবদ্ধ বলে ‘নিত্য”। লক্ষণীয় যে, ব্যাসবাক্য সমাসবদ্ধ থাকে বলে 'নিত্যসমাসে ব্যাসবাক্য হয় না' বলা হয়। কেবল জ্ঞান= জ্ঞানমাত্র। এই স্থলে সমস্তপদ বা সমাসের অর্থ প্রকাশ করতে ব্যাসবাক্যে ‘মাত্র’শব্দের একই অর্থবোধক ‘কেবল' শব্দের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এরকম – কেবল নাম = নামমাত্র, অন্য গ্রাম = গ্রামান্তর, অন্য গৃহ = গৃহান্তর, অন্য মত = মতান্তর, অন্য লোক = লোকান্তর, অন্য ভাষা = ভাষান্তর, অন্য দিন = দিনান্তর, অন্য রূপ = রূপান্তর, অন্য যুগ = যুগান্তর, কেবল দর্শন = দর্শনমাত্র, কেবল একটি = একটিমাত্র, গিরির তুল্য = গিরিনিভ ইত্যাদি।
⑧ অলোপ সমাস : সমাসে সাধারণভাবে পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হয় না। সমাসনিষ্পন্ন হওয়ার পরেও পূর্বপদের বিভক্তি আগের মতোই থেকে যায় অর্থাৎ, লোপ পায় না। একে বলা হয় অলোপ সমাস। (নয় লোপ= অলোপ।) অলোপ সমাস কোনো আলাদা সমাস নয়। দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি যে-কোনো সমাসের ক্ষেত্রে পূর্বপদের বিভক্তি সমাসনিষ্পন্ন হওয়ার পরেও লোপ না পেলে, সেই সমাসের অলোপ হয়। যেমন—অলোপ দ্বন্দ্ব, অলোপ তৎপুরুষ, অলোপ উপপদ, অলোপ বহুব্রীহি ইত্যাদি।
❏ অলোপ দ্বন্দ্ব : বনে ও বাদাড়ে = বনে-বাদাড়ে, দুধে ও ভাতে = দুধে-ভাতে, বুকে ও পিঠে = বুকে-পিঠে, জিনিসেও মানুষে = জিনিসে মানুষে। এরকম – বনে-জঙ্গলে, জলে-কাদায়, কোলে-পিঠে, মাঠে-ময়দানে ইত্যাদি।
❏ অলোপ তৎপুরুষ : (ক) অলোপ করণ : হাতে (হাত দ্বারা) কাটা = হাতে-কাটা, তেলে (তেল দিয়ে) ভাজা = তেলে ভাজা, ঘিয়ে (ঘি দিয়ে) ভাজা = ঘিয়ে-ভাজা, তাসের (তাস দিয়ে) ঘর = তাসের ঘর। এরকম — হাতে-গড়া, বাপে-তাড়ানো, মায়ে- খেদানো, তাঁতে বোনা, কলে ছাঁটা, সাপে কাটা, ভূতে ধরা, পোকায়-কাটা ইত্যাদি। (খ) অলোপ নিমিত্ত : ভুলের (ভুলের জন্য) মাশুল = ভুলের মাশুল, ভাতের (ভাতের জন্য) হাঁড়ি = ভাতের-হাঁড়ি।
(গ) অলোপ অপাদান : ঘানির (ঘানির থেকে) তেল = ঘানির তেল, আকাশ থেকে পড়া = আকাশ-থেকে- পড়া ইত্যাদি। (ঘ) অলোপ সম্বন্ধ : টাকার কুমির = টাকার-কুমির, মনের মানুষ = মনের-মানুষ, গড়ের মাঠ=গড়ের মাঠ, ষাঁড়ের গোবর = ষাঁড়ের-গোবর, চোখের বালি = চোখের বালি, অনুরোধের আসর = অনুরোধের-আসর ইত্যাদি।
(ঘ) অলোপ অধিকরণ : গায়ে হলুদ = গায়ে হলুদ, দিনে ডাকাতি দিনে-ডাকাতি, অরণ্যে রোদন = অরণ্যে-রোদন, অঙ্কে কাঁচা = অঙ্কে-কাঁচা, গোড়ায় গলদ = গোড়ায় গলদ, বাসে কেনা = বাসে-কেনা ইত্যাদি।
❏ অলোপ উপপদ : খেচরে যে= খেচর, গায়ে পড়ে যে = গায়ে-পড়া, মনে ধরে যা = মনে-ধরা ইত্যাদি।
❏ অলোপ বহুব্রীহি : হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = হাতে-খড়ি, মাথায় পাগড়ি যার = মাথায়-পাগড়ি, গায়ে হলুদ দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = গায়ে হলুদ, (শিশুর) মুখে প্রথম ভাত দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = মুখে-ভাত ইত্যাদি।
⑨ বাক্যাশ্রয়ী সমাস : যে সমাসবদ্ধ পদকে আশ্রয় করে এক-একটি বাক্যের অর্থ প্রকাশিত হয়, তাকে বাক্যাশ্রয়ী সমাস বলে। যেমন—চক্ষু-অপারেশন-শিবির, বসে আঁকা প্রতিযোগিতা, সব-পেয়েছির-দেশ ইত্যাদি। বাক্যাশ্রয়ী সমাস প্রকৃতপক্ষে মিশ্র সমাসবদ্ধ পদ। বাক্যাশ্রয়ী সমাসকে ভাঙলে ব্যাসবাক্য ও সমাস কী দাঁড়ায় উদাহরণ দিয়ে দেখা যাক। চক্ষু-অপারেশন-শিবির = চক্ষুর অপারেশন (সম্বন্ধ তৎ), তার নিমিত্ত শিবির (নিমিত্ত তৎ)।
বসে-আঁকা-প্রতিযোগিতা = বসে আঁকা = বসে-আঁকা (অলোপ অধিকরণ), বসে আঁকার প্রতিযোগিতা (সম্বন্ধ তৎ)। সবুজ-বাঁচাও-কমিটি = সবুজকে বাঁচাও (কর্মতৎ) এমন নির্দেশ, তার কমিটি (সম্বন্ধ তৎ)। কৃষি-উন্নয়ন-সভা = কৃষির উন্নয়ন (সম্বন্ধ তৎ), কৃষি-উন্নয়নের উদ্দেশ্যে সভা (মধ্যপদলোপী কর্মধারয়)। রক্ত-দান-শিবির = রক্তের দান (সম্বন্ধ তৎ), তার নিমিত্ত শিবির (নিমিত্ত তৎ) ইত্যাদি।