কারক কাকে বলে? কারক ও বিভক্তি | কারক ও বিভক্তি নির্ণয়


কারক কাকে বলে? কারক ও বিভক্তি | কারক ও বিভক্তি নির্ণয় কারক এর উদাহরণ

karok bengali grammar

‘কারক’ কী তা জানতে হলে 'কারক' কথার অর্থ প্রথমে জানা দরকার। 'কারক' শব্দের প্রকৃতি-প্রত্যয়গত অর্থ ও ব্যাকরণে প্রয়োগগত অর্থ এক নয়, ভিন্ন। 'কারক' শব্দের প্রকৃতি-প্রত্যয়গত রূপ হলো √কৃ + অক = কারক। অর্থ হলো যিনি করেন, যিনি নির্মাণ করেন, যিনি সৃষ্টি করেন ইত্যাদি। ব্যাকরণে ‘কারক' শব্দের প্রয়োগগত অর্থ হলো বাক্যের অন্যান্য পদের সঙ্গে ক্রিয়ার সম্পর্ক হলো কারক। সংস্কৃত বৈয়াকরণরা বলেছেন 'ক্রিয়ান্বয়ী কারকম্”। অর্থাৎ ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের সম্পর্ক হলো কারক। কিন্তু দেখা গেছে ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের সকল পদের সম্পর্ক থাকে, আবার থাকেও না। যেমন- (১) মনোজ দুপুরে ভাত খায়। 'খায়' ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের সম্পর্ক আছে কিনা দেখা যাক। 'কে',‘কি’,‘কখন' দিয়ে ‘খায়' ক্রিয়াকে প্রশ্ন করলে দেখা যায় 'খায়' ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের সকল পদের চমৎকার সম্পর্ক আছে।

★ দৃষ্টান্ত দেখো 
'কে' খায়-মনোজ
☞ ‘কি’ খায়—ভাত
☞ ‘কখন’ খায়—দুপুরে

(২) সাপের হাঁচি বেদে চেনে। 'চেনে' ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের সকল পদের সম্পর্ক আছে কিনা দেখা যাক। 'কে', 'কি' দিয়ে ‘চেনে' ক্রিয়াকে প্রশ্ন করলে দেখা যায় ‘চেনে’ ক্রিয়ার সঙ্গে ‘বেদে’ও ‘হাঁচি' পদের সম্পর্ক আছে। কিন্তু ‘সাপের পদের সঙ্গে ‘চেনে' ক্রিয়ার সম্পর্ক নেই।

★ দৃষ্টান্ত দেখো 
'কে' চেনে-বেদে
☞ 'কি' চেনে-হাঁচি

(৩) ওহে, এসো। 'এসো' ক্রিয়ার সঙ্গে “ওহে' পদের সম্পর্ক নেই । (২) ও (৩) নং বাক্যের ‘সাপের' ও ‘ওহে’ পদ কারক নয়, অ-কারক।  কাজেই, বাক্যের ক্রিয়ার সঙ্গে ওই বাক্যের যে পদ বা যে যে পদের সম্পর্ক থাকে, তা কারক।

(খ) কারকের শ্রেণিবিভাগ
কারক কী—সে সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণা হয়েছে। আমরা এখন কারকের শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আলোচনা করব।
পঞ্চায়েত প্রধান তাঁর অফিসে বন্যার্তদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে কর্মচারীদের দিয়ে ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছেন। এটি একটি বাক্য। এই বাক্যে ‘দিচ্ছেন’ ক্রিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন পদের নানা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ‘দিচ্ছেন' ক্রিয়াকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে তা পরিষ্কার করে জেনে নেওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, ক্রিয়ার সঙ্গে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদের এই সম্পর্কই কারক-সম্পর্ক।

বিভিন্ন পদের সঙ্গে ক্রিয়ার কারক-সম্পর্ক :
ক্রিয়াকে প্রশ্ন
▸কে দিচ্ছেন?
▸কী দিচ্ছেন?
▸কাদের দিয়ে দিচ্ছেন?

উত্তর (কারক-সম্পর্ক)
▸পঞ্চায়েত প্রধান (কর্তৃ)
▸ত্রাণসামগ্রী (কর্ম)
▸কর্মচারীদের দিয়ে (করণ)

ক্রিয়াকে প্রশ্ন
▸কাদের জন্য দিচ্ছেন?
▸কী থেকে দিচ্ছেন?
▸কোথায় দিচ্ছেন?

উত্তর (কারক-সম্পর্ক)
▸বন্যার্তদের জন্য (নিমিত্ত)
▸ সরকারি তহবিল থেকে (অপাদান)
▸ তাঁর অফিসে (অধিকরণ)

 কারক কয় প্রকার ও কি কি? বিভিন্ন পদের সঙ্গে ক্রিয়ার কারক-সম্পর্ক অনুযায়ী কারক (6) ছয় প্রকার- ① কর্তৃ কারক , ② কর্ম কারক , ③ করণ কারক , ④ নিমিত্ত কারক , ⑤ অপাদান কারক ও ⑥ অধিকরণ কারক।

উদাহরণসহ প্রকারভেদ :
❍ কর্তৃ কারক
[পঞ্চায়েত প্রধান]   
❍ কর্ম কারক  
[ত্রাণসামগ্রী]
❍ করণ কারক
[কর্মচারীদের দিয়ে]
❍ নিমিত্ত কারক
[বন্যার্তদের জন্য] 
❍ অপাদান কারক
[ সরকারি তহবিল থেকে]
❍ অধিকরণ কারক
[তাঁর অফিসে]

① কর্তৃ কারক :  ক্রিয়া হলো কাজ। যে কাজ করে, সে কর্তা। যেমন- (১) যদু লেখে। (২) লীলা বই পড়ে। (৩) বীণা গান গায় আর নাচে। প্রথম বাক্যে ‘লেখা’ কাজের কর্তা ‘যদু’। দ্বিতীয় বাক্যে 'বই পড়া' কাজের কর্তা 'লীলা'। তৃতীয় বাক্যে 'গাওয়া’ও ‘নাচা’ দুটি কাজেরই কর্তা ‘বীণা'। তা ছাড়া প্রতিটি বাক্যে ক্রিয়াকে 'কে' দিয়ে প্রশ্ন করলে ক্রিয়ার সঙ্গে ‘যদু’, ‘লীলা' ও ‘বীণা’-র কর্তৃ-সম্পর্ক বেরিয়ে আসে। যে ক্রিয়া নিষ্পন্ন করে, সে কর্তা। ক্রিয়ার সঙ্গে কর্তৃ-সম্বন্ধযুক্ত পদকে বলা হয় কর্তৃকারক। যেমন- (১) “বনে থাকে বাঘ, গাছে থাকে পাখি।' (২) 'পাটনাতে এসেছেন সাধু রামানন্দ। প্রতিটি বাক্যের ক্রিয়াকে 'কে' দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা হলো ওই ক্রিয়ার কর্তা।

❏ কর্তৃকারকের প্রকারভেদ :
  • প্রযোজক কর্তা : কর্তা নিজে কাজ না করে অপরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিলে, তাকে বলা হয় প্রযোজক কর্তা। মা ছেলেকে চাঁদ দেখান। ‘চাঁদ দেখা’ কাজটি মা ছেলেকে দিয়ে করিয়ে নেন। ‘মা’-প্রযোজক কর্তা। এরকম—' মোক্ষদা ছাগলশিশুকে সযত্নে ফ্যানজল খাওয়াত। ' দিদিমণি মেয়েটিকে ইংরেজি পড়াবেন।
  • প্রযোজ্য কর্তা : অপরের প্রেরণায় যে কাজ করে, তাকে বলা হয় প্রযোজ্য কর্তা। যেমন-মা ছেলেকে চাঁদ দেখান। নিজের ইচ্ছায় নয়, মায়ের প্রেরণায় ছেলে চাঁদ দেখে। 'ছেলে’-প্রযোজ্য কর্তা। এরকম—তারা শিশুটিকে কাঁদাচ্ছে কেন?"
  • নিরপেক্ষ কর্তা: বাক্যে অসমাপিকা ও সমাপিকা ক্রিয়ার পৃথক পৃথক কর্তা থাকলে, অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না হওয়ায় নিরপেক্ষ হয়ে পড়ে, সেজন্য অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তাকে বলা হয় নিরপেক্ষ কর্তা। যেমন—সূর্য অস্ত গেলে অন্ধকার নামে। 'গেলে' অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা ‘সূর্য”। ‘নামে' সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক না থাকায় নিরপেক্ষ কর্তা। এরকম—ঝড় থামলে আমরা দরজা খুললাম। সূর্য উঠলে পদ্ম ফোটে।
  • বাক্যাংশ কর্তা : বাক্যের কিছুটা অংশ ক্রিয়ার কর্তা হলে, তাকে বলে বাক্যাংশ কর্তা। যেমন—'ভয়কারে কয় নাইকো জানা।'
  • হ্য কর্তা : বাক্যের কর্তা উহ্য থাকলে এ ধরনের কর্তাকে বলা হয় উহা কর্তা। যেমন- এসো।'—কর্তা 'তুমি' উহ্য। এক ক্রিয়ার একাধিক কর্তা : কোনো কোনো বাক্যে একটি ক্রিয়ার একের বেশি কর্তা থাকে। যেমন-ভোজ খেল পিন্টু, মিন্টু, অনেকে
  • একাধিক ক্রিয়ার এক কর্তা : কোনো কোনো বাক্যে এক কর্তার অধীনে থাকে একের বেশি ক্রিয়া। যেমন-পাগলটা হাসছে, নাচছে, কাঁদছে।
  • ব্যতিহার কর্তা : একই ক্রিয়ার দুই কর্তার পরস্পরের মধ্যে কাজ করার অর্থ প্রকাশিত হলে, ওই দুই কর্তাকে বলা হয় ব্যতিহার কর্তা। যেমন—পণ্ডিতে পণ্ডিতে তর্ক হয়। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া করে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়।
  • সহযোগী কর্তা : ক্রিয়ার দুই কর্তার মধ্যে পারস্পরিকতা না বুঝিয়ে সহযোগিতা বোঝালে সহযোগী কর্তা হয়।যেমন—আমাদের বড়োবাবুর দাপটে বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খায়। মায়ে-ঝিয়ে কাজ করে।
  • সমধাতুজ কর্তা : ক্রিয়াপদটি যে ধাতু থেকে গঠিত, সেই ধাতু থেকে গঠিত বিশেষ্য পদ ওই ক্রিয়ার কর্তা হলে, তাকে বলা হয় সমধাতুজ কর্তা। যেমন-উৎসবের বাজনা বাজছে। ‘বাজ' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন বিশেষ্য পদ‘বাজনা', ‘বাজ' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াপদ‘বাজছে’।‘বাজছে ক্রিয়ার কর্তা ‘বাজনা”। এরকম—কত ঘটনা ঘটেছে। পড়ুয়া তখনও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ছে।
☞  কর্তৃকারকের প্রকারভেদ ও উদাহরণ :
❍ প্রযোজক কর্তা
[মা ছেলেকে চাঁদ দেখান।]
❍ প্রযোজ্য কর্তা
[তারা শিশুটিকে কাঁদাচ্ছে কেন?]
❍ নিরপেক্ষ কর্তা
[সূর্য উঠলে পদ্ম ফোটে।]
❍ বাক্যাংশ কর্তা
[চুরি করা পাপ কাজ।]
❍ একাধিক ক্রিয়ার এক কর্তা
[পাগলটা হাসছে, নাচছে, কাঁদছে।]
❍ এক ক্রিয়ার একাধিক কর্তা
[ভোজ খেল পিন্টু, মিন্টু, অনেকে।]
❍ উহ্য কর্তা
[(তুমি) এসো।]
❍ ব্যতিহার কর্তা
[রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়।]
❍ সহযোগী কর্তা
[মায়ে-ঝিয়ে কাজ করে।]
❍ সমধাতুজ কর্তা
[কত ঘটনা ঘটেছে।]

 কর্তৃকারকে বিভিন্ন বিভক্তির প্রয়োগ : শূন্য (অ)—'আমি দিব্যচক্ষু পেয়েছি।' (কে)——তাঁকে টিকিট কিনতে
হয়নি।’(র)—বাবুর কোথায় যাওয়া হচ্ছে? (এর) মহাশয়ের আসা ঠিক হয়নি। (দের) 'মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে।
(এ)—পাগলে কিনা বলে। (তে) হাঁসগুলোতে গুগলি খাচ্ছে। (য়)— তোমায় এ কথা বলতে হবে।'

② কর্ম কারক  কর্ম' শব্দের অর্থ কাজ। কর্তা যে পদকে অবলম্বন করে কাজ করে তা কর্ম। যেমন- (১) সুরেশ মাটি কাটে। (২) কুকুরটা মাংস খায়। (৩) চাষিরা মাঠে ধান চাষ করে।

প্রথম বাক্যে কর্তা ‘সুরেশ’ 'মাটি' পদকে অবলম্বন করে 'কাটা' কাজটি করে। দ্বিতীয় বাক্যে কর্তা ‘কুকুরটা’ ‘মাংস’
পদকে অবলম্বন করে ‘খাওয়া’ কাজটি করে। তৃতীয় বাক্যে কর্তা ‘চাষিরা ‘ধান' পদকে অবলম্বন করে 'চাষ করা’ কাজটি করে। কাজেই ‘মাটি’, ‘মাংস' ও 'ধান' কর্ম। প্রতি বাক্যের ক্রিয়াকে ‘কী' দিয়ে প্রশ্ন করলে 'ক্রিয়ার' সঙ্গে 'মাটি', 'মাংস' ও 'ধান'-এর কর্ম-সম্পর্ক বেরিয়ে আসে। যে পদ ক্রিয়ার সঙ্গে কর্ম-সম্বন্ধ নিষ্পন্ন করে, তাকে বলা হয় কর্মকারক। যেমন-‘স্বামীর নাম নাহি ধরে নারী।' মাকে প্রণাম করল। 'বরকে সভায় আনা যাবে না।' প্রতিটি বাক্যের ক্রিয়াকে 'কী' বা 'কাকে' দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা ওই ক্রিয়ার কর্ম।

❏ কর্মকারকের প্রকারভেদ :
  • মুখ্য কর্ম ও গৌণ কর্ম : বাক্যে দ্বিকর্মক ক্রিয়ার দুটি কর্ম থাকে। ক্রিয়াপদের সঙ্গে মুখ্য সম্পর্কযুক্ত কর্মটি হয় মূখ্য কর্ম, আর গৌণ সম্পর্কযুক্ত কমটি হয় গৌণ কর্ম। মুখ্য কর্মটি হয় বস্তুবাচক, গৌণ কর্মটি হয় প্রাণীবাচক। যেমন—'তাহলে আপনি আমার স্বর্গীয় পিতামহাশয়কে এই রামায়ণ পড়তে দেখেছেন। 'এই রামায়ণ' মুখ্য কর্ম, 'পিতামহাশয়কে' গৌণ কর্ম।
  • উদ্দেশ্য কর্ম ও বিধেয় কর্ম : কিছু ক্রিয়ার কর্মের পরিপূরক হিসেবে অন্য যে পদ ব্যবহার করা হয়, সেই পরিপূরক পদকে বলা হয় বিধেয় কর্ম, আর আসল কর্মটিকে বলা হয় উদ্দেশ্য কর্ম। উদ্দেশ্য কর্ম হয় বিভক্তিযুক্ত, বিধেয় কর্ম হয় বিভক্তিশূন্য। যেমন—আমরা চিত্তরঞ্জন দাশকে দেশবন্ধু বলি। দেশবাসী তাঁকে রাষ্ট্রপতি করেছেন।
  • সমধাতুজ কর্ম : ক্রিয়াপদটি যে ধাতু থেকে গঠিত, সেই ধাতু থেকে গঠিত বিশেষ্য পদ ওই ক্রিয়ার কর্ম হলে, তাকে বলা হয় সমধাতুজ কর্ম। যেমন-লোকটি কী ঘুমই না ঘুমাল। ‘ঘুম্‌ ধাতু থেকে গঠিত ক্রিয়া ঘুমাল আর 'ঘুম' ধাতু থেকে গঠিত বিশেষ্য পদ ‘ঘুম’। সমধাতুজ কর্মে শূন্য বিভক্তি হয়। অকর্মক ক্রিয়া সকর্মকরূপে ব্যবহৃত হয়। এরকম—ছেলেটি কী দৌড়ই না দৌড়ায়। মেয়েটি কী নাচই না নাচে।
  • অনুক্ত কর্ম : সকর্মক ক্রিয়ার কর্ম উহ্য থাকলে, তাকে বলা হয় অনুক্ত কর্ম। যেমন- কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান ।
  • 'বাক্যাংশ কর্ম: বাক্যের সমাপিকা ক্রিয়াহীন কিছুটা অংশ কর্মরূপে ব্যবহৃত হলে, তাকে বলা হয় বাক্যাংশ কর্ম। যেমন— সবেতে তার গা ঝাড়া ভাব আমরা সইতে পারি নে।' শেষ বেলার রক্ত-রাঙা আকাশ আমরা দেখেছি।
  • কর্মের বীপ্সা : একই কর্মের বার বার উল্লেখকে বলা হয় কর্মের বীপ্সা। যেমন- যা যা বলছি, করো। জনে জনে ডাকো।
কর্মকারকে বিভিন্ন বিভক্তির প্রয়োগ : শূন্য (অ) 'ঘোড়া ফেরাও।' (রে)-হরিরে ভজ সবে। (এরে) রামেরে শুধালেন সীতা। (এ)-‘বৃথা গঞ্জ দশাননে। (য়) আমায় ডেকেছ পিতা? (র)-নিরক্ষরতা জাতির অভিশাপ। (এর)-বন্যার্তের সেবা করা উচিত। (কে)—এবার তোকে নিয়ে যাচ্ছি মা।'

③ করণ কারক :  (১) এ কলমে ভালো লেখা হয়। (২) ব্যায়ামে দেহ সুগঠিত হয়। (৩) আমরা চোখ দিয়ে দেখি।
প্রথম বাক্যে ‘লেখা’ কাজ হয়েছে ‘কলমে’। দ্বিতীয় বাক্যে ‘দেহ সুগঠিত হওয়ার’কাজ হয় ‘ব্যায়ামে’। তৃতীয় বাক্যে ‘দেখা’ কাজ হয় ‘চোখ দিয়ে’। তিনটি বাক্যে ‘লেখা হয়, ‘হয়’ ও ‘দেখি ‘কী দিয়ে' বা ‘কীসের দ্বারা' দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তরস্বরূপ পাওয়া যায় যথাক্রমে ‘কলমে’, ‘ব্যায়ামে’ ও ‘চোখ দিয়ে’। এগুলির সাহায্যে কর্তা কার্য সম্পাদন করে, সেজন্য করণ। যে পদ ক্রিয়ার সঙ্গে করণ-সম্বন্ধ নিষ্পন্ন করে, তাকে করণকারক বলা হয়। যেমন-
(১) লাঠিতে সাপ মারা হলো।
(২) ছেলেরা বল খেলে।
(৩) করাত দিয়ে কাঠ কাটা হয়েছে।

করণকারকের প্রকারভেদ :
  • যন্ত্রাত্মক করণ : যে বস্তু বা যন্ত্র দিয়ে কাজ করা হয়, তা যন্ত্রাত্মক করণ। যেমন-ছুরি দিয়ে পেনসিল কাটা হয়।
  • উপায়াত্মক করণ : যে উপায় দ্বারা কাজ সম্পন্ন হয়, তা উপায়াত্মক করণ। যেমন-নিয়মিত শরীরচর্চায় দেহ সুঠাম হয়।
  • হৈতুময় করণ : হেতু বা কারণ অর্থ বোঝাতে হেতুময় করণ হয়। যেমন- 'ভয়ে (ভয়-হেতু) প্রাণ কাঁপতে লাগল।'
  • কালাত্মক করণ : সময় বা কালজ্ঞাপক করণকে বলা হয় কালাত্মক করণ। যেমন- তিরিশ দিনে এক মাস হয়।
  • সমধাতুজ করণ : ক্রিয়াপদটি যে ধাতু থেকে তৈরি, সেই ধাতু থেকে করণকারকটিও তৈরি হলে, তাকে বলা হয়
  • সমধাতুজ করণ। যেমন—'মায়ার বাঁধনে বেঁধেছ আমায়।'
  • লক্ষণাত্মক করণ : লক্ষণপ্রকাশক করণকে লক্ষণাত্মক করণ বলা হয়। যেমন—শিকারি বিড়াল গোঁফে চেনা যায়।
  • করণের বীপ্সা : পোস্টারে পোস্টারে দেয়াল ছয়লাপ। ‘পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী।'
করণকারকে বিভিন্ন বিভক্তি ও অনুসর্গের প্রয়োগ : শূন্য (অ)- তারা তাস খেলছে। (র) - মরেছে লাঠির ঘায়ে ।
(এর)—তাঁতের তৈরি কাপড়। (এ)- পাথরে পা কেটে গেল।' (তে)——তাতে দেহ স্নিগ্ধ হল।' (য়)—'গণনায় দেখা গেল।' (দিয়া/দিয়ে)—শাক দিয়া/দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। (দ্বারা)-ষষ্টি দ্বারা প্রহার করা হইয়াছে। [হতে (< হইতে)]—আমা হতে/হইতে এ/ এই কর্ম হবে/হইবে না সাধন। (থেকে) প্রণবের থেকে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই ।

④ নিমিত্ত কারক :   স্বত্বত্যাগপূর্বক দানকে সম্প্রদান বলা হয়। সংস্কৃতে ক্রিয়ার সঙ্গে সম্প্রদান সম্বন্ধকে সম্প্রদানকারক বলে। সম্প্রদান কারকের জন্যে সংস্কৃতে চতুর্থী বিভক্তি নির্দিষ্ট আছে। বাংলায় সম্প্রদানের জন্য কোনো বিভক্তি পৃথক করে নির্দিষ্ট নেই। সাধারণত কর্মকারকের বিভক্তি দিয়ে সম্প্রদানের কাজ চালানো হয়। যেমন-ক্ষুধাতুরকে অন্ন দাও। ‘ক্ষুধাতুর শব্দের সঙ্গে ‘কে’বিভক্তি যুক্ত হয়েছে। গৌণ কর্মেও একই বিভক্তি ব্যবহার করা হয়। যেমন—যদুকে গল্পটি বলো। গৌণ কর্ম ‘যদু’-তে ‘কে’বিভক্তি যুক্ত হয়েছে। সেজন্য বাংলায় সম্প্রদান কারকের পৃথক ব্যবহার দেখাতে আধুনিক বৈয়াকরণেরা চান না। বাংলায় সম্প্রদানকারক বর্জন করে নিমিত্তকারকের ব্যবহার হয়েছে।

ক্রিয়ার সঙ্গে নিমিত্ত-সম্বন্ধ (নিমিত্ত, জন্য ইত্যাদি অর্থ) বোঝাতে যে কারক হয়, তাকে বলা হয় নিমিত্তকারক।
যেমন—'বেলা যে পড়ে এল জলকে চল।' এই বাক্যে 'চল' ক্রিয়াকে 'কীসের নিমিত্ত চলা' দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে ‘জলকে’, নিমিত্তকারক। এরকম আরও দৃষ্টান্ত : 'তোমার পতাকা যারে দাও।’“যারে' অর্থাৎ ‘যার জন্য’। ‘মৃতজনে দেহ প্রাণ।’‘মৃতজনে' অর্থাৎ, মৃত ব্যক্তির নিমিত্ত।

নিমিত্তকারকে বিভিন্ন বিভক্তির প্রয়োগ : শূন্য (অ)— তোমা (তোমার জন্য/নিমিত্ত) দিব সর্বস্ব। (কে)- সকলেই
কন্যাকে (কন্যার জন্য) অলংকার দিয়েছে।' (রে)-'সে আমারে (আমার জন্য) গৃহ করে দান।' (এরে) ভক্তেরে (ভক্তের জন্য) দিলেন সব। (র)-দেবতার (দেবতার জন্য নিবেদিত) ধন কে নেয় কেড়ে? (এর) তীরের (তীরের জন্য)প্রতীক্ষা। (দের) ছেলেদের (ছেলেদের জন্য) খাবার দাও। (এ)-অন্ধজনে (অন্ধজনের জন্য) দেহ আলো।

⑤ অপাদান কারক : (১) তিল থেকে তেল হয়। (২) বাদল মেঘে বৃষ্টি হয় । (৩) ঘোড়া থেকে নামল।
প্রথম বাক্যে তিল থেকে উৎপন্ন, দ্বিতীয় বাক্যে মেঘ থেকে পতিত, তৃতীয় বাক্যে ঘোড়া থেকে নামা বোঝাচ্ছে।
প্রথম বাক্যে ‘তেল হয় কী থেকে”, দ্বিতীয় বাক্যে ‘বৃষ্টি হয় কী থেকে’, তৃতীয় বাক্যে 'নামল কী থেকে' দিয়ে প্রশ্ন করলে যথাক্রমে উত্তর হয় ‘তিল থেকে’, ‘বাদল মেঘে’, ‘ঘোড়া থেকে'। এগুলি অপাদান। যা থেকে কোনো কিছু চলিত, ভীত, গৃহীত, রক্ষিত, পতিত, বিরত, উৎপন্ন হয়, তাকে অপাদান বলে। যে পদ ক্রিয়ার সঙ্গে অপাদান-সম্বন্ধ গড়ে, তাকে বলা হয় অপাদানকারক।

অপাদান কারকের প্রকারভেদ : 
  • আধার বা স্থানবাচক অপাদান: রথ থেকে লাফিয়ে পড়লেন। কলকাতা থেকে ডাক্তার এসেছেন। 'রথ' আধার,‘কলকাতা’স্থান। কোনো আধার বা স্থান থেকে পতিত, আগত ইত্যাদি অর্থ বোঝালে আধার বা স্থানবাচক অপাদান হয়।
  • কালবাচক অপাদান : লোকটা সকাল থেকে বসে আছে। বাক্যে কাল বা সময় বোঝানো হয়েছে।
  • দূরত্ববাচক অপাদান : বুঁদির কেল্লা চিতোর হতে যোজন তিনেক দূর।' কলকাতা থেকে মুম্বাই অনেক দূর। দুটি বাক্যে যথাক্রমে চিতোর ও কলকাতা থেকে দূরত্ব বোঝানো হয়েছে।
  • তারতম্যবাচক অপাদান : লতার চেয়ে অসীমা বয়সে বড়ো। বাক্যে তারতম্য বা তুলনা বোঝানো হয়েছে।
❏ অপাদাকারকে বিভিন্ন বিভক্তি ও অনুসর্গের প্রয়োগ : শূন্য (অ)—ছেলেটা স্কুল পালায়। (কে)-ঠাকুরদা যমকেও ভয় করতেন না। (এর) বাঘের ভয়ে পিলে চমকায়। (দিগের)-দস্যুদিগের ভয়ে সে নির্বাক। (এ)- বিপদে মোরে রক্ষা করো।' (য়)–টাকায় টাকা লাভ হয়েছে। (তে) ইহাতে আলকাতরার জন্ম। (দিয়া)গা দিয়া ঘাম ঝরিতেছে। (দিয়ে)—ক্ষতমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। (হইতে)- অশ্ব হইতে নামিল। (থেকে)-রথ থেকে লাফিয়ে পড়লেন।

⑥ অধিকরণ কারক: ক্রিয়ার আধার হলো অধিকরণ। যে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদে বাক্যস্থিত ক্রিয়ার আধার, কাল, স্থান ইত্যাদি বোঝায়, তাকে অধিকরণকারক বলে। যেমন- বনে বাঘ আছে। শিশুকালে ভোগবিলাসের আয়োজন ছিল না। প্রাচীন দুটি ছাতিমের তলায় মার্বেল পাথরে বাঁধানো একটি নিরলংকৃত বেদি। এই তিনটি বাক্যে ‘বাঘ কোথায় আছে’, ‘কখন ভোগবিলাসের আয়োজন ছিল না, ‘কোথায় নিরলংকৃত বেদি' এই প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে যথাক্রমে ‘বনে’ ‘শিশুকালে’, ‘ছাতিমের তলায়', স্থান ও সময় বুঝিয়েছে। কাজেই এগুলি অধিকরণকারক।

 অধিকরণকারকের প্রকারভেদ : অধিকরণকারক তিন প্রকার-(ক) স্থানাধিকরণ, (খ) কালাধিকরণ, (গ) বিষয়াধিকরণ।

(ক)স্থানাধিকরণ : যে স্থানে ক্রিয়ানিষ্পন্ন হয়, তাকে বলে স্থানাধিকরণ। যেমন—'ঢেলারে ভাঙিবে শিরে'।
স্থানাধিকরণ তিন প্রকার-(i) ঐকদেশিক, (ii) বাপ্তিসূচক, (iii) সামীপ্যসূচক।
  • (i) ঐকদেশিক : সমগ্র স্থান জুড়ে নয়, একটি স্থান বা অংশ জুড়ে ক্রিয়া অনুষ্ঠানের অবস্থান বোঝালে ঐকদেশিক স্থানাধিকরণ হয়। যেমন—কলকাতায় চিড়িয়াখানা আছে। পলাশ বিলাতে পড়ছে। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ।
  • (ii) ব্যাপ্তিসূচক : কোনো অংশবিশেষ নয়, সর্বদেশ বা সকল অংশ জুড়ে ব্যাপ্ত হয়ে অবস্থান করছে, বোঝালে ব্যাপ্তিসূচক স্থানাধিকরণ হয়। যেমন—তিলে তেল আছে। বরফে শীতলতা আছে। খেজুর রসে শর্করা আছে।
  • (iii) সামীপ্যসূচক : সামীপ্য বা নিকটে বোঝাতে যে অধিকরণ, তাকে বলা হয় সামীপ্যসূচক স্থানাধিকরণ। যেমন—দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি।
(খ) কালাধিকরণ : যে কালে বা যে সময়ে ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় সেই কালজ্ঞাপক অধিকরণকে কালাধিকরণ বলে। কালাধিকরণ দু-প্রকার—(1) মুহূর্তাধিকরণ, (2) ব্যাপ্তাধিকরণ।
  • (1) মুহূর্তাধিকরণ : সময়ের নির্দিষ্ট মুহূর্তজ্ঞাপক অধিকরণকে মুহূর্তাধিকরণ বলা হয়। যেমন-বেলা দশটায় বাজার খোলে।
  • (2) ব্যাপ্তাধিকরণ: ক্রিয়ার কালবিস্তৃত অধিকরণকে বলা হয় ব্যাপ্তাধিকরণ। যেমন—শীতকালে রাত্রি বড়ো হয়।
(গ) বিষয়াধিকরণ : কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে ক্রিয়ানিষ্পন্ন হলে বিষয়াধিকরণ হয়। যেমন- ছেলেটি গণিতে কাঁচা

অধিকরণে বীপ্সা: 'ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে।‘পাতায় পাতায় পড়ে নিশার শিশির।'

❏ অধিকরণকারকে বিভিন্ন বিভক্তি ও অনুসর্গের প্রয়োগ : শূন্য (অ)—কাবুল পৌঁছাবেন। (কে)— 'বাজে না আজিকে ঝলমল গান।' (এর) 'বনের পাখি ছিল বনে।' (হইতে)—পাহাড়ের শিখর হইতে তাহাকে দেখিলাম। (থেকে) বাড়ির আঙিনা থেকে পাহাড় দেখা যায়। (এ)'সে তো অন্নদামঙ্গলে আছে।' (তে) তিনি গাড়িতে বসে আছেন। (য়) বারান্দায় তার বিছানা।

কারক আলোচনায় আমরা দেখেছি ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের যে সম্পর্ক তা হলো কারক । এখন প্রশ্ন হলো, ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের সম্পর্ক গড়ে কে? ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের পদের সম্পর্ক গড়ে বিভক্তি, বিভক্তি না পারলে অনুসর্গ, সময়ে বিভক্তি ও অনুসর্গ উভয়ে মিলে। [এখানে অনুসর্গ আলোচ্য বিষয় নয়।]

ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যস্থ পদের শুধু সম্পর্কই কারক নয়। ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যস্থ পদের অর্থগত সম্পর্কও বাংলা কারকের
ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। যে জন্য কারককে বলা যেতে পারে ‘অর্থগত সম্পর্কও। ওপরের প্রথম উদাহরণে মনোজ' ভাত খাওয়ার কাজ সম্পন্ন করে। ‘ক্রিয়া সম্পাদনের অর্থপ্রকাশক হিসেবে’‘মনোজ' হলো কর্তা বা কর্তৃকারক। ক্রিয়ার দ্বারা যে বস্তু বা ব্যক্তি সরাসরি প্রভাবিত হয় তা কর্ম, ভাত' এমন অর্থ প্রকাশ করায় 'ভাত' হলো কর্ম বা কর্মকারক। ‘খায়’ক্রিয়াটি যে কালে সম্পন্ন হচ্ছে, তা দুপুর'।‘খায়’ক্রিয়ার কালবা সময় অর্থবোধক শব্দ‘দুপুর'। 'দুপুর’ অধিকরণকারক। এই আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি-কারক শুধু ক্রিয়ান্বয়ী' নয়, ‘অর্থগত সম্পর্কও। কাজেই, কারক সম্পর্কে এ কথা বলা যায়, ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের অন্বয় বা সম্পর্ক ও সেইসঙ্গে ক্রিয়ার সঙ্গে পদের অর্থগত সম্পর্ককে বলা হয় কারক।

নীচের উদাহরণের ছকটি দেখলে ‘বিভক্তি'-র ধারণা অনেকটা স্পষ্ট হবে।
বাক্যে শব্দ + বিভক্তি কারক
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে। বুলবুলি + তে কর্তৃ
মাকে জড়িয়ে ধরত। মা + কে কর্ম
জলে মাছ আছে। জল + এ অধিকরণ

যেমন- প্রথম বাক্যে 'বুলবুলি' শব্দের সঙ্গে 'তে' বিভক্তি যোগ হয়েছে। ‘ধান খাওয়া' কাজ করছে 'বুলবুলি'। এখানে
'বুলবুলি' কর্তা। ক্রিয়ার সঙ্গে বুলবুলি কর্তার সম্পর্ক গড়েছে 'তে' বিভক্তি। দ্বিতীয় বাক্যে কাকে জড়িয়ে ধরা
হতো? 'মাকে'। মায়ের সঙ্গে 'জড়িয়ে ধরা” ক্রিয়ার সম্পর্ক গড়েছে ‘কে’বিভক্তি। ‘মাকে’কর্ম। তৃতীয় বাক্যে
মাছ কোথায় থাকে? 'জলে'। জল মাছ থাকার স্থান বা আধার। 'আছে' ক্রিয়ার সঙ্গে জলের স্থানাধিকরণ সম্পর্ক গড়েছে 'এ' বিভক্তি। কাজেই, বাংলা ভাষার যে বিশেষ বিশেষ বিভক্তি শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শব্দকে পদবাচ্য করে বাক্যের ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বাক্যের ভিন্ন ভিন্ন পদের কারক নির্দিষ্ট করে, তাকে বিভক্তি বলা হয়।

লক্ষ করো : (১) ‘তে’, ‘কে', 'এ' বাংলা ভাষার বিশেষ বিশেষ বিভক্তি। (২) তা শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শব্দকে পদে পরিণত করে।(৩) পদ ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে কারক নির্দেশ করে। (৪) এ ধরনের বিভক্তি শব্দ-বিভক্তি।এগুলি কারক-নির্দেশক শব্দ-বিভক্তি। বাংলা ভাষায় বাক্যে বিভক্তি প্রকৃতপক্ষে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।

এক, বাক্যে পদের কারক সম্পাদনের কাজ করে। 
দুই, বাক্যে ক্রিয়ার কালবোধক চিহ্ন নিষ্পন্নের কাজ করে।

অবশ্য এখানে একমাত্র আলোচ্য বিষয় হলো কারক-নির্দেশক বিভক্তি। বাক্যে কারক সম্পন্ন করতে বিভক্তির বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। বাংলায় বিভক্তির সংখ্যা মাত্র পাঁচটি-এ, কে, রে, তে, র। তা ছাড়া আছে শূন্য বিভক্তি। ‘র’ বিভক্তি সম্বন্ধপদের। সংস্কৃতে বিভক্তির সংখ্যা অনেক এবং প্রতি কারকের জন্য বিভক্তি সুনির্দিষ্ট আছে। বাংলায় কোনো
কারকের জন্য বিভক্তি সুনির্দিষ্ট নেই। ‘এ’বিভক্তি বাংলায় সকল কারকে 

(ক) কারক সম্পাদন : জীবনেরে কে পারে লঙ্ঘিতে ? জীবন + এরে = জীবনেরে [কর্মকারকে 'এরে' বিভক্তি]।
(খ) কালবোধক চিহ্ন : মেয়েটি বই  পড়ছে। পড় + ছে। ‘ছে’ ঘটমান বর্তমান কালের চিহ্ন।

প্রযুক্ত হয়। কর্তৃ, করণ ও অধিকরণ কারকে একই ধরনের কিছু বিভক্তি চিহ্নের ব্যবহার দেখা যায়। প্রয়োগবিশেষে বিভক্তি ‘এ’,‘য়ে’,‘য়’হয় ; ‘তে’,‘এতে’হয়; ‘রে’,‘এরে’ হয়; ‘র’, ‘এর’হয়; কেবল 'কে'-এর অন্য
কোনো রূপ হয় না। যেমন-
  • কর্তৃকারক- এ (য়ে, য়), তে (এতে)।
  • করণকারক- এ (য়ে, য়), তে (এতে)।
  • অপাদানকারক- এ (য়), তে।
  • সম্বন্ধপদে-র, এর।
  • কর্মকারক- এ (য়ে, য়), কে, রে (এরে)।
  • নিমিত্তকারক- কে, রে (এরে), এ।
  • অধিকরণকারক- এ (য়ে, য়), তে (এতে)।
সুতরাং সংস্কৃত ব্যাকরণে বিভক্তি সম্পর্কে যে বলা হয় 'সংখ্যা-কারক বোধয়িত্রী বিভক্তিঃ, তা বাংলা ব্যাকরণে
অনুসৃত হওয়ার যৌক্তিকতা নেই। বাংলায় কর্তৃকারকে প্রথমা, কর্মকারকে দ্বিতীয়া এভাবে সংখ্যা অনুযায়ী কারকের জন্য বিভক্তি সুনির্দিষ্ট করা যায় না এবং ওই সংখ্যা অনুযায়ী বিভক্তি চিহ্ন সুনির্দিষ্ট করলে তাতে কারকের বোধ সৃষ্টির পরিবর্তে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সেজন্য বাংলায় সংখ্যা অনুযায়ী না হয়ে কারক অনুযায়ী বিভক্তি চিহ্নের উল্লেখ বাঞ্ছনীয়। অ-কারক সম্বন্ধের জন্য 'র' বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। প্রয়োগবিশেষে ‘র’ হয় ‘এর’। সকল কারকেই ‘র’বা ‘এর’ বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। কর্তৃ-সম্বন্ধ : বোলতার কামড়, কর্ম-সম্বন্ধ : বিদ্যার চর্চা, করণ-সম্বন্ধ : তুলির টান ইত্যাদি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন