Definition and Explanation of Respiration | শ্বসন | সবাত শ্বসন | অবাত শ্বসন | সন্ধান | মানুষের শ্বাসযন্ত্র এবং শ্বসন পদ্ধতি


   শ্বসন [ RESPIRATION ]

১। শ্বসনের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা (Definition and Explanation of Respiration) : 1780 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ার (Lavoisier) প্রথম শ্বসন কথাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেন, শ্বসন একপ্রকার দহন প্রক্রিয়া যার দ্বারা জীবকোশ-মধ্যস্থ ‘শ্বসন' বস্তুঅক্সিজেন দ্বারা জারিত হয়ে শক্তি নির্গত করে। শ্বসন' কথাটি লাতিন শব্দ 'রেসপিরেয়ার (Respirare) অর্থাৎ 'শ্বাসকার্য' থেকে উৎপত্তি হয়েছে। জৈবিক প্রয়োজনে জীবদেহে প্রতিনিয়ত নানাপ্রকার জৈবনিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন শক্তি। জীব খাদ্য গ্রহণ করে ওই শক্তি অর্জন করে। খাদ্যস্থিত স্থৈতিকশক্তি যা সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৌরশক্তি থেকে সঞ্চিত হয়, তা শ্বসন নামক জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গতিশক্তি বা তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই গতিশক্তি বা তাপশক্তির দ্বারা জীব খাদ্যগ্রহণ, বৃদ্ধি, চলন, রেচন, জনন প্রভৃতি শারীরবৃত্তীয় কার্য সম্পন্ন করে থাকে। আসলে জীবদেহে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্য সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপন্ন করাই শ্বাসকার্যের তথা শ্বসনের একমাত্র উদ্দেশ্য।

শ্বসনের সংজ্ঞা (Definition of Respiration) : যে জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবকোশস্থ খাদ্যবস্তু অক্সিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে জারিত হয়ে খাদ্যস্থ স্থৈতিকশক্তি গতিশক্তি বা তাপশক্তিতে রূপান্তরিত ও মুক্ত হয় এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ও জল উৎপন্ন হয়, তাকে শ্বসন (Respiration) বলে।

শ্বসন একপ্রকার অপচিতি বিপাক (Respiration is a catabolic metabolism) : শ্বসন প্রক্রিয়ায় জটিল খাদ্যবস্তু ভেঙে সরল উপাদানে পরিণত হয় এবং শক্তি মুক্ত করে। ফলে জীবদেহের শুষ্ক ওজন হ্রাস পায়। তাই শ্বসনকে অপচিতি বিপাক বলা হয়। শ্বসন একটি তাপমোচী প্রক্রিয়া।

২।  শ্বসনস্থল (Site of Respiration) : উদ্ভিদ এবং প্রাণীর প্রতিটি সজীব কোশে দিবারাত্র প্রতিনিয়ত শ্বসন সংঘটিত হয়। শ্বসনের প্রথম পর্যায় অর্থাৎ গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়াটি কোশের সাইটোপ্লাজমে এবং দ্বিতীয় তা পর্যায় অর্থাৎ ক্রেবসচক্র কোশীয় অঙ্গাণু মাইটোকন্ড্রিয়ায় ঘটে। মাইটোকন্ড্রিয়ার মধ্যে শ্বসনের অধিকাংশ রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি ঘটার কারণে প্রচুর শক্তি (38 অণু ATP) উৎপন্ন হয় বলে মাইটোকন্ড্রিয়াকে কোশের শক্তিঘর (Power houses of cell) বলা হয়। ATP-র মধ্যে শক্তি সঞ্চিত থাকায় ATP-কে এনার্জি কারেন্সি বা শক্তির ভাণ্ডার বলে।

৩। শ্বসন কখন হয়? 
When Respiration occurs
☞ উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রতিটি সজীব কোশে দিবারাত্র শ্বসন ঘটে। প্রাণীদেহের বর্ধিষ্ণু অঙ্গে এবং উদ্ভিদের কাণ্ড ও মূলের অগ্রভাগে, বীজের অঙ্কুরোদ্‌গমের সময় শ্বসনহার দ্রুততর হয়। পক্ষান্তরে, পরিণত কোশে শ্বসনহার অপেক্ষাকৃত কম।

৪। শ্বসন বস্তু ও শক্তি (Respiratory Substrate and Energy) : শ্বসনকালে যেসব জৈব বস্তু সজীব কোশে জারিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে, তাদের শ্বসন বস্তু (Respiratory substrate) বলে। গ্লুকোজ (C6H12O6) সজীব কোশের প্রধান শ্বসন বস্তু। এছাড়াও সময় বিশেষে প্রোটিন, ফ্যাট, গ্লাইকোজেন, জৈব অ্যাসিড ইত্যাদিও শ্বসন বস্তু হিসেবে জারিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তি খাদ্যের মধ্যে স্থৈতিকশক্তিরূপে আবদ্ধ হয়। শ্বসনকালে আবার খাদ্যস্থ স্থৈতিকশক্তি গতিশক্তি বা তাপশক্তিরূপে মুক্ত হয়। এক গ্রাম অণু গ্লুকোজ (180g) সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে প্রায় 686 kcal (কিলোক্যালোরি) তাপশক্তি উৎপন্ন করে। এই তাপশক্তি ATP অণুর মধ্যে রাসায়নিক শক্তিরূপে সঞ্চিত থাকে। পরে জৈবিক প্রয়োজনে ATP অণু বিশ্লেষিত হয়ে পুনরায় শক্তি উৎপন্ন করে এবং জীবদের জৈবিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করে।

ক্যালোরি কী? 
What is Calorie ?
☞ তাপ বা শক্তি পরিমাপের একককে ক্যালোরি বলে। এক গ্রাম বিশুদ্ধ জলের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি করতে যে পরিমাণ তাপশক্তির প্রয়োজন হয় তাকে এক ক্যালোরি তাপশক্তি বলে। হাজার ক্যালোরিতে এক কিলোক্যালোরি (kcal) হয়।

শ্বসনের লক্ষণ (Sign of respiration) : (i) অক্সিজেন (O2) গ্রহণ। (ii) খাদ্যবস্তুর জারণ এবং শুষ্ক ওজন হ্রাস। (iii) অল্প পরিমাণ জল (H2O) এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) বর্জন। (iv) তাপশক্তি উৎপাদন। 

৫। শ্বসন ও শ্বাসকার্যের পার্থক্য (Difference between Respiration and Breathing): শ্বসন ক্রিয়া জীবের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই অন্তঃকোশীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সজীব কোশ জৈব বস্তুর ভাঙনের ফলে শক্তি সংগ্রহ করে। অপরদিকে শ্বাসকার্য একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া যা কোশের বাইরে শ্বাসগ্রহণ বা প্রশ্বাস (Inspiration) এবং শ্বাসত্যাগ বা নিঃশ্বাস (Expiration)-কে বোঝায়। উচ্চশ্রেণির প্রাণীরা ফুসফুস, নিম্নশ্রেণির প্রাণীরা বিভিন্ন শ্বাসযন্ত্র এবং উদ্ভিদেরা পত্ররন্ধ্র, লেন্টিসেল, শ্বাসমূল ইত্যাদির সাহায্যে গ্যাসীয় আদানপ্রদান ঘটিয়ে শ্বাসকার্য চালায়।

✸ শ্বসন ও শ্বাসকার্যের প্রধান পার্থক্যগুলি হল :
শ্বসন বা অন্তঃস শ্বাসকার্য বা বহিঃশ্বসন
1. জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। 1. যান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
2. অন্তঃকোশীয় প্রক্রিয়া। 2. বহিঃকোশীয় প্রক্রিয়া।
3. শক্তির রূপান্তর ঘটে। 3. শক্তির রূপান্তর ঘটে না।
4. সজীব কোশে সংঘটিত হয়। 4. শ্বাস-অঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
5. গ্লাইকোলাইসিস ও ক্রেবস চক্র এই দুটি পর্যায়ে বিভক্ত। 5. শ্বাসগ্রহণ ও শ্বাসত্যাগ এই দুটি পর্যায়ে বিভক্ত।
6. উৎসেচকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। 6. উৎসেচকের কোনো ভূমিকা নেই।
7. ATP উৎপন্ন হয়। 7. ATP উৎপন্ন হয় না।


৬। শ্বসন ও দহনের পার্থক্য (Difference between Respiration and Combustion) : যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কোশস্থ খাদ্য অক্সিজেনের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে জারিত হয়ে খাদ্যস্থ স্থৈতিকশক্তি গতিশক্তিতে রূপান্তরিত ও মুক্ত হয়, তাকে শ্বসন (Respiration) বলে। শ্বসন একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া যা প্রোটোপ্লাজম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। উৎসেচক এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কোনো জৈব বা অজৈব বস্তু উৎসেচক ছাড়া কেবল অক্সিজেনের উপস্থিতিতে জারিত হয়ে তাপ ও আলো উৎপন্ন করে এবং শক্তির দ্রুত মুক্তি ঘটায়, তাকে দহন (combustion) বলে। দহন একটি অজৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া যা প্রোটোপ্লাজম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। যে-কোনো দাহ্য বস্তুতে দহন সম্ভব।

শ্বসন ও দহনের প্রধান পার্থক্যগুলি হল :
শ্বসন দহন
1. শ্বসন একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। 1. দহন একটি অজৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া।
2. শ্বসনের সময় খাদ্যবস্তু ধাপে ধাপে জারিত হয়ে শক্তি নির্গত হয় বলে এটি একটি নিয়ন্ত্রিত দহন প্রক্রিয়া। 2. দহনের সময় অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতি দ্রুত তাপ নির্গত হয় বলে এটি একটি অনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া।
3. এই প্রক্রিয়ায় উৎসেচকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। 3. এই প্রক্রিয়ায় উৎসেচকের কোনো ভূমিকা থাকে না।
4. শ্বসন জীবদেহের প্রতিটি সজীব কোশে দিবারাত্র চলে। 4. দহন যে-কোনো দাহ্য বস্তুতে যে-কোনো সময় সম্ভব।
5. প্রক্রিয়াটি অক্সিজেন ছাড়াও (অবাত শ্বসন) ঘটতে পারে। 5. অক্সিজেন ছাড়া দহন সম্ভব নয়।
6. শ্বসনে শক্তির মুক্তি ধীরে ধীরে ঘটে। 6. দহনে শক্তির মুক্তি দ্রুত ঘটে।
7. এই প্রক্রিয়ায় আলো উৎপন্ন হয় না কিন্তু তাপ সৃষ্টি হয়। 7. এই প্রক্রিয়ায় আলো এবং তাপ উভয়ই উৎপন্ন হয়।

৭। সবাত শ্বসন, অবাত শ্বসন এবং সন্ধান সম্পর্কে সাধারণ ধারণা (Simple Idea about Aerobic, Anaerobic Respiration and Fermentation) : অক্সিজেনের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ওপর নির্ভর করে শ্বসনকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা— 
① সবাত শ্বসন
② অবাত শ্বসন
➂ সন্ধান


① সবাত শ্বসন (Aerobic respiration) : মুক্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে শ্বসন বস্তুর জারণকে সবাত শ্বসন বলে। উদ্ভিদ এবং প্রাণীদেহের প্রতিটি জীবিত কোশে সবাত শ্বসন ঘটে।
 অবাত শ্বসন (Anaerobic respiration) : মুক্ত অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে শ্বসন বস্তুর জারণকে অবাত শ্বসন বলে। কতিপয় ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে অবাত শ্বসন দেখা যায় ৷
 সন্ধান (Fermentation) : অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে শ্বসন বস্তু আংশিকভাবে জারিত হয়ে জৈবযৌগ সৃষ্টি করাকে সন্ধান বলে। ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির জীব দ্বারা সন্ধান সংঘটিত হয়।

সবাত শ্বসন [AEROBIC RESPIRATION]

সংজ্ঞা (Definition) : যে শ্বসন পদ্ধতিতে মুক্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বায়ুজীবী জীবকোশ-মধ্যস্থ শ্বসন বস্তু (গ্লুকোজ) সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও জল উৎপন্ন করে এবং শ্বসন বস্তু-মধ্যস্থ শক্তি সম্পূর্ণরূপে নিৰ্গত (686 kcal) হয়, তাকে সবাত শ্বসন বলে।

সবাত শ্বসনের স্থান (Site of aerobic respiration) : সকল বায়ুজীবী জীবে (aerobic organism) অর্থাৎ এককোশী উদ্ভিদ (ক্ল্যামাইডোমোনাস, ক্লোরেল্লা) ; এককোশী প্রাণী (অ্যামিবা), বহুকোশী উন্নত উদ্ভিদ এবং প্রাণীদেহের প্রতিটি সজীব কোশে এরূপ শ্বসন ক্রিয়া সংঘটিত হয়।

সবাত শ্বসন পদ্ধতি (Mechanism of aerobic respiration) : সবাত শ্বসনে কোশস্থ খাদ্য প্রধানত গ্লুকোজ অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড, জল এবং শক্তি উৎপন্ন করে। সবাত শ্বসন প্রক্রিয়াটি দুটি পর্যায়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যথা— (i) গ্লাইকোলাইসিস, অর্থাৎ গ্লুকোজ অণুর পাইরুভিক অ্যাসিডে পরিণত। (ii) ক্রেবস চক্র, অর্থাৎ পাইরুভিক অ্যাসিডের পরবর্তী জারণে উৎপন্ন CO2, জল এবং শক্তি।

(i) গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis) : শ্বসনের যে পর্যায়ে গ্লুকোজ অণু বিভিন্ন উৎসেচকের সহায়তায় ধারাবাহিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে আংশিক ভাবে জারিত হয়ে পাইরুভিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে, তাকে গ্লাইকোলাইসিস বলে। পর্যায়টি কোশের সাইটোপ্লাজমে ঘটে। এম্বডেন (Embden), মেয়ারহফ (Mayerhof) এবং পার্নেস (Parnes) নামক তিন বিজ্ঞানী প্রথম এর বিক্রিয়াটিকে পর্যবেক্ষণ করেন বলে তাঁদের নামানুসারে গ্লাইকোলাইসিস পর্যায়টিকে EMP পথ বলে। এই পর্যায়ে এক অণু 6 কার্বনযুক্ত যৌগ গ্লুকোজ বিভিন্ন উৎসেচকের সহায়তায় এবং কতকগুলি ধারাবাহিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে জারিত হয়ে 2 অণু 3-কার্বন যুক্ত পাইরুভিক অ্যাসিড এবং 2 অণু ATP উৎপন্ন করে। গ্লাইকোলাইসিসে উৎপন্ন পাইরুভিক অ্যাসিড শ্বসন প্রক্রিয়ার (সবাত এবং অবাত) একটি অন্তঃমধ্যবর্তী পদার্থ।

(ii) ক্রেবস চক্র (Krebs cycle) : সবাত শ্বসনের যে পর্যায়ে গ্লাইকোলাইসিসে  উৎপন্ন পাইরভিক অ্যাসিড সম্পূর্ণ জারিত হয়ে বিভিন্ন প্রকার জৈব অ্যাসিড তৈরির মাধ্যমে একটি চক্রাকার পথে COজল এবং শক্তি উৎপন্ন করে, তাকে ক্রেবস চক্র বলে। ক্রেবস চক্রে উৎপাদিত বিভিন্ন জৈব অ্যাসিডগুলির মধ্যে প্রথম উৎপাদিত দ্রব্য সাইট্রিক অ্যাসিড হওয়ায়, এই চক্রকে সাইট্রিক অ্যাসিড চক্র বলে। সাইট্রিক অ্যাসিডে তিনটি কার্বক্সিল বর্গ (-COOH) থাকায় একে ট্রাই কার্বক্সিলিক অ্যাসিড চক্র বা TCA চক্র এবং প্রথম পর্যবেক্ষক ইংরেজ বিজ্ঞানী হ্যানস ক্রেবস (Hans Krebs-1937)-এর নামানুসারে একে ক্রেবস চক্র বলে। ক্রেবস চক্রটি কোশীয় অঙ্গাণু মাইটোকন্ড্রিয়ার মধ্যে ঘটে।

সবাত শ্বসনের দ্বিতীয় পর্যায়ে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে পাইরুভিক অ্যাসিড কোএনজাইম A নামক উৎসেচকের সাহায্যে অ্যাসিটাইল Co–A উৎপন্ন করে ক্রেবস চক্রে প্রবেশ করে এবং অক্সালোঅ্যাসেটিক অ্যাসিডের (4–C) সঙ্গে বিক্রিয়া করে সাইট্রিক অ্যাসিড (6–C) উৎপন্ন করে। এই সাইট্রিক অ্যাসিড বিভিন্ন উৎসেচকের সহায়তায় এবং কয়েকটি অন্তর্বর্তী যৌগ তৈরির মাধ্যমে পুনরায় অক্সালোঅ্যাসেটিক অ্যাসিডে (4–C) পরিণত হয়। ক্রেবস চক্রে পাইরুভিক অ্যাসিড 6 অণু অক্সিজেনের সহযোগে সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে 6 অণু CO2, 6 অণু H2O এবং 686 kcal শক্তি উৎপন্ন করে। শ্বসনের ফলে মোট 38 অণু ATP উৎপন্ন হয়।

মাইকোলাইসিসের তাৎপর্য : (i) এই প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ অণুতে আবদ্ধ ATP শক্তি মুক্ত হয়। (ii) এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন অন্তবর্তী পদার্থ পাইরুভিক অ্যাসিড, ক্রেবস চক্রের প্রাথমিক উপাদান,রূপে ব্যবহৃত হয়। (iii) গ্লাইকোলাইসিসে যে অল্প পরিমাণ তাপ নির্গত হয় তা অবাত শ্বসনকারী জীবের বিপাকীয় কার্য চালানোর প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস।

ক্রেবস চক্রের তাৎপর্য : (i) জীবের বিভিন্ন বিপাকীয় কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির প্রধান উৎসস্থল। (ii) এর মাধ্যমে উদ্ভিদে বিভিন্ন ধরনের জৈব অ্যাসিড উৎপন্ন হয় (iii) উৎপন্ন জৈব অ্যাসিড নাইট্রোজেন বিপাক বিশেষ করে অ্যামাইনো অ্যাসিড সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। (iv) ক্রেবস চক্রে উৎপন্ন জৈব অ্যাসিডগুলি উদ্ভিদের জৈব অ্যাসিড বিপাকে অংশ নেয়।

অবাত শ্বসন [ANAEROBIC RESPIRATION]

 সংজ্ঞা (Definition) : যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় অবায়ুজীবী জীবকোশে যেসব জীব বায়ুমণ্ডলের মুক্ত অক্সিজেন গ্রহণ না করে শ্বসন ক্রিয়া সম্পন্ন করে, তাদের অবায়ুজীবী জীব বলে। যেমন—ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, কৃমি, মনোসিসটিস ইত্যাদি। মাইটোকন্ড্রিয়া না থাকায় আদি কোশযুক্ত জীবদের সবাত শ্বসন হয় না। মুক্ত অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে কোশস্থ খাদ্য বা শ্বসন বস্তু (গ্লুকোজ) অক্সিজেনযুক্ত যৌগের অক্সিজেন দ্বারা জারিত হয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড, জল ও শক্তি উৎপন্ন করে, তাকে অবাত শ্বসন বলে।

এই অবাত শ্বসনের স্থান (Site of anaerobic respiration) : সালফার ব্যাকটেরিয়া, মিথেন ব্যাকটেরিয়া, ডিনাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়াতে অবাত শ্বসন দেখা যায়।
অবাত শ্বসনে অক্সিজেনের উৎস (Sources of Oxygen in anaerobic respiration) : নাইট্রেট (NO3), কার্বনেট (CO3), সালফেট (SO4) প্রভৃতি অক্সাইড যৌগ অবাত শ্বসনে অক্সিজেন সরবরাহ করে। প্রান্তীয় শ্বসন পথ সংক্ষিপ্ত বলে অবাত শ্বসনে কম পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়।

✸ সবাত শ্বসন ও অবাত শ্বসনের পার্থক্য :
সবাত শ্বসন অবাত শ্বসন
1. সবাত শ্বসনে মুক্ত অক্সিজেনের একান্ত প্রয়োজন। 1. অবাত শ্বসনে মুক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না , কিন্তু অক্সিজেনযুক্ত যৌগের অক্সিজেন প্রয়োজন হয়।
2. সকল বায়ুজীবী জীবের কোশে সবাত শ্বসন ঘটে। 2. সকল অবায়ুজীবী ব্যাকটেরিয়া কোশে অবাত শ্বসন ঘটে।
3. এই প্রকার শ্বসনে গ্লুকোজের সম্পূর্ণ জারণ ঘটে। 3. গ্লুকোজের অসম্পূর্ণ জারণ ঘটে।
4. সবাত শ্বসন কোশের সাইটোপ্লাজম এবং মাইটোকন্ড্রিয়ায় ঘটে। 4. অবাত শ্বসন কেবলমাত্র কোশের সাইটোপ্লাজমে ঘটে।
5. কার্বন ডাইঅক্সাইড, জল এবং শক্তি উৎপন্ন হয়। 5. কার্বন ডাইঅক্সাইড, জল, অক্সাইড যৌগ এবং শক্তি উৎপন্ন হয়।
6. সবাত শ্বসন প্রতি অণু গ্লুকোজ জারণে 686 kcal তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। ফলে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ অনেক বেশি। 6. অবাত শ্বসনে প্রতি অণু গ্লুকোজ জারণে 50 kcal তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। ফলে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ অনেক কম।


➂ সন্ধান [FERMENTATION]

সংজ্ঞা (Definition) : যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় শ্বসন বস্তু (গ্লুকোজ) অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট জাতীয় ছত্রাকের দেহকোশে আংশিকভাবে জারিত হয়ে বিভিন্ন জৈব যৌগ সৃষ্টি করে এবং শ্বসন বস্তুস্থিত শক্তির আংশিক নির্গমন ঘটে, তাকে সন্ধান বলে।

সন্ধান একপ্রকার অবাত শ্বসন প্রক্রিয়া। ইস্ট নামক এককোশী ছত্রাকের মধ্যে বিজ্ঞানী পাস্তুর (Pasteur 1857 ) প্রথম কোহল সন্ধান প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করেন। অবাত শ্বসন এবং সন্ধান উভয় পদ্ধতি মুক্ত অক্সিজেন ছাড়াই ঘটে। পদ্ধতি দুটির জারণ ক্রিয়া আবার হাইড্রোজেন পরমাণু অপসারণের মাধ্যমে হয়। অবাত শ্বসনে হাইড্রোজেন পরমাণু অক্সিজেনযুক্ত কোনো অজৈব যৌগের (CO3, SO4, NOইত্যাদি) সঙ্গে মিলিত হয়। অপরদিকে সন্ধানে ওই হাইড্রোজেন পরমাণু পুনরায় পাইরুভিক অ্যাসিড অথবা পাইরুভিক অ্যাসিড থেকে উৎপন্ন কোনো জৈব পদার্থের সঙ্গে মিলিত হয়।

সন্ধানের স্থান (Site of fermentation) : কতিপয় বায়ুজীবী ও অবায়ুজীবী আণুবীক্ষণিক জীবের দ্বারা সন্ধান প্রক্রিয়া ঘটে। সরল শর্করা দ্রবণে প্রধানত ইস্ট দ্বারা এবং দুধে ল্যাক্টোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সন্ধান প্রক্রিয়া ঘটে। এছাড়া উদ্ভিদের অঙ্কুরিত বীজে, প্রাণীদেহের পেশিকোশে এবং আণুবীক্ষণিক জীবদেহেও সন্ধান চলে।

সন্ধানের প্রকারভেদ (Types of fermentation) : জীবাণু ও ছত্রাকের প্রকৃতি অনুসারে সন্ধান বিভিন্ন প্রকার, যেমন—কোহল সন্ধান, ল্যাকটিক অ্যাসিড সন্ধান, অ্যাসেটিক অ্যাসিড সন্ধান ইত্যাদি।

1. কোহল সন্ধান (Alcoholic fermentation) : যে প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ দ্রবণ ইস্ট নিঃসৃত উৎসেচকের প্রভাবে আংশিক জারিত হয়ে ইথাইল অ্যালকোহল,  এবং অল্প পরিমাণ তাপ নির্গত করে এবং দ্রবণটি গেঁজে ওঠে, তাকে কোহল সন্ধান বলে। খেজুর ও তালের রস ইস্টের উপস্থিতিতে সন্ধান প্রক্রিয়ায় ইথাইল অ্যালকোহল এবং CO2 উৎপন্ন করে গেঁজে ওঠে, একে তাড়ি বলে।

2. ল্যাকটিক অ্যাসিড সন্ধান (Lactic acid fermentation) : যে প্রক্রিয়ায় দুগ্ধ শর্করা (ল্যাকটোজ) ল্যাকটোব্যাসিলাস নামক ব্যাকটেরিয়ার দেহে উৎসেচকের প্রভাবে আংশিক জারিত হয়ে ল্যাকটিক অ্যাসিড ও অল্প পরিমাণ তাপ নির্গত করে এবং দুধকে দই-এ পরিণত করে, তাকে ল্যাকটিক অ্যাসিড সন্ধান বলে। ল্যাকটিক অ্যাসিড সন্ধানে COউৎপন্ন হয় না।

3. অ্যাসেটিক অ্যাসিড সন্ধান (Acetic acid fermentation) : যে প্রক্রিয়ায় শর্করা কতিপয় ব্যাকটেরিয়ার দেহে উৎসেচকের প্রভাবে ভিনিগার প্রস্তুতকারক অ্যাসেটিক অ্যাসিডে পরিণত হয়, তাকে অ্যাসেটিক অ্যাসিড সন্ধান বলে।

✸ পেশির ক্লান্তি কী?
☞ অতিরিক্ত পরিশ্রমের সময় পেশিকোশে অক্সিজেনের অভাবে সন্ধান প্রক্রিয়ায় ল্যাকটিক অ্যাসিড সঞ্চিত হলে পেশির ক্লান্তি ঘটে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ল্যাকটিক অ্যাসিড দুরীভূত হয়, পুনরায় পেশির স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।

✸ সন্ধানের অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance of fermentation) : অর্থনৈতিক দিক থেকে সন্ধান প্রক্রিয়ার ব্যাবহারিক গুরুত্ব অপরিসীম। (i) অ্যালকোহল বা সুরা প্রস্তুতি। (ii) গবেষণাগারে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত ইথাইল অ্যালকোহল। (iii) দই, ভিনিগার ইত্যাদি প্রস্তুতিতে। (iv) পাঁউরুটি ও বিস্কুট কারখানায়। (v) নানাবিধ খাদ্যসামগ্রী ও রাসায়নিক শিল্পজাত দ্রব্য প্রস্তুতিতে।

৮।  শ্বাসঅঙ্গ (Respiratory Organs) : জীবদেহের যেসব অঙ্গ শ্বাসকার্যে সাহায্য করে তাদের শ্বাসঅঙ্গ বলে।যেমন : মানুষের ফুসফুস, পতঙ্গদের ট্রাকিয়া, মাছের ফুলকা ইত্যাদি। উদ্ভিদের নির্দিষ্ট কোনো শ্বাস অঙ্গ থাকে না। উচ্চশ্রেণির উদ্ভিদরা দেহগাত্র, পত্ররন্ধ্র, লেন্টিসেল, শ্বাসমূল ইত্যাদির সাহায্যে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড বর্জন করে।

উদ্ভিদের শ্বসনে সহায়ককারী অঙ্গ :
1. দেহগাত্র (Body Surface) : উচ্চশ্রেণির জলজ উদ্ভিদেরা নিমজ্জিত অংশের দেহগাত্র দিয়ে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে।
2. পত্ররন্ধ্র (Stomata) : উদ্ভিদের পাতার বহিস্ত্বকে অসংখ্য সূক্ষ্ম রন্ধ্র বা পত্ররন্দ্র থাকে। বিষমপৃষ্ঠ পাতার নিম্নত্বকে এবং সমাঙ্কপৃষ্ঠ পাতার উভয় ত্বকে পত্ররন্ধ্র থাকে। এইসব পত্ররন্ধ্র দুটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি জীবিত রক্ষীকোশ দ্বারা বেষ্টিত একটি রন্ধ্র নিয়ে গঠিত। রক্ষীকোশ পত্ররন্ধ্র বন্ধ এবং খুলতে সহায়তা করে। এই পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে গ্যাসীয় আদানপ্রদান ঘটে।
3. লেন্টিসেল (Lenticell) : গুল্ম ও বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদের বায়ব অংশে বিশেষ করে ত্বকের বিদীর্ণ অংশে একপ্রকার ছোটো ছোটো ছিদ্র দেখা যায়, তাদের লেন্টিসেল বলে। লেন্টিসেল শ্বাসঅঙ্গ রূপে উদ্ভিদের গ্যাসীয় আদানপ্রদান ঘটায়।
4. শ্বাসমূল (Pneumatophore) : সুন্দরী, গরান, গেঁও প্রভৃতি লবণাম্বু বা ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদের সমুদ্র উপকূলবর্তী লবণাক্ত অঞ্চলে শ্বাসকার্যের সুবিধার জন্য শ্বাসমূল সৃষ্টি হয়েছে। এই সব উদ্ভিদের শাখাপ্রশাখাযুক্ত স্থানিক মূলগুলি মাটি ভেদ করে খাড়াভাবে উপরে উঠে আসে। শ্বাসছিদ্রযুক্ত মূলগুলিকে শ্বাসমূল বলে। এই শ্বাসছিদ্রের মাধ্যমে এই সব গাছ বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে।

৯। প্রাণীদের শ্বাসঅঙ্গ (Respiratory Organs of Animals) : প্রাণীরাজ্যে শ্বাসকার্য পদ্ধতি বৈচিত্র্যে ভরা। প্রাণীরা প্রধানত বাতাস কিংবা জল থেকে অক্সিজেন নিয়ে শ্বসন ক্রিয়া সম্পন্ন করে। বাসস্থানের প্রকৃতি এবং অভিযোজন ও অভিব্যক্তির ওপর নির্ভর করে প্রাণীদের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের শ্বাসযন্ত্র দেখা যায়। যেমন— 1. দেহগাত্র (Body Surface) : দেহতল দ্বারা ব্যাপন প্রক্রিয়ায় শ্বাসকার্য চালায়। যেমন—অ্যামিবা, হাইড্রা, স্পঞ্জ ইত্যাদি। 2. ত্বক বা চামড়া (Skin) : দেহের আর্দ্র ও জালকপূর্ণ ত্বককে শ্বাসঅঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন—কেঁচো, জোঁক ইত্যাদি। 3. শ্বাসছিদ্র এবং শ্বাসনালি (Spiracle and Trachea) : সন্ধিপদ শ্রেণির প্রাণীরা দেহমধ্যস্থ দশজোড়া শ্বাসছিদ্র ও শ্বাসনালির মাধ্যমে শ্বাসকার্য চালায়। যেমন—আরশোলা, প্রজাপতি, ফড়িং ইত্যাদি। 4. ফুলকা (Gills) : ফুলকা বেশিরভাগ জলজ প্রাণীদের প্রধান শ্বাসযন্ত্র। যেমন— রুই, কাতলা, চিংড়ি, শামুক ইত্যাদি। 5. অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র (Accessory respiratory organs) : ফুলকা ছাড়া কতিপয় জিয়ল মাছের দেহে অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র দেখা যায়। যেমন—কই, শিঙি, মাগুর ইত্যাদি। 6. বুকলাং (Booklung) : সন্ধিপদ পর্বের কিছু প্রাণীদের আবার পুস্তকের মতো ফুসফুস দেখা যায়। যেমন—মাকড়সা, কাকড়াবিছে ইত্যাদি। 7. বহিঃফুলকা (External gills) : ব্যাঙাচি অবস্থায় জলে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য বহিঃফুলকা শ্বাসযন্ত্র হিসেবে কাজ করে। 8. ফুসফুস (Lung) : উন্নত শ্রেণির প্রাণীদের প্রধান শ্বাসযন্ত্র ফুসফুস বা লাং। যেমন—উভচর, পক্ষী, সরীসৃপ, মানুষ ইত্যাদি।

✸ শ্বাসঅঙ্গের বৈশিষ্ট্য :
(i) শ্বাসঅঙ্গগুলি অর্থভেদ্য, আর্দ্র এবং বিস্তৃত।
(ii) শ্বাসঅঙ্গগুলি প্রচুর রক্তজালক পরিবৃত থাকে।
(iii) শ্বাসঅঙ্গগুলি সরাসরি শ্বসন মাধ্যমের সংস্পর্শে থাকে।

প্রাণীদের শ্বাসঅঙ্গসমূহের নাম :
  1. অ্যামিবা, স্পঞ্জ, হাইড্রা → দেহতল। 
  2. কেঁচো, জোঁক  → দেহত্বক
  3. আরশোলা, প্রজাপতি, ফড়িং প্রভৃতি পতঙ্গ শ্রেণিভুক্ত প্রাণী→  শ্বাসছিদ্র এবং শ্বাসনালি
  4. মাছ, চিংড়ি, শামুক → ফুলকা
  5. কই, শিঙি, মাগুর → ফুলকা, অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র
  6. ব্যাঙাচি → বহিঃ ফুলকা
  7. মাকড়সা, কাঁকড়াবিছে → বুকলাঙ বা পুস্তক ফুসফুস
  8. শামুক, ঝিনুক → ফুলকা
  9. চিংড়ি, রাজকাকড়া → বুকগিল বা পুস্তক ফুলকা
  10. ব্যাঙ (উভচর) → ফুসফুস, চামড়া, মুখবিবর গলবিলের মিউকাস পর্দা
  11. সরীসৃপ (সাপ, টিকটিকি, গিরগিটি, কচ্ছপ) → ফুসফুস
  12. পক্ষী → ফুসফুস ও বায়ুথলি
  13. স্তন্যপায়ী (তিমি, বাদুড়, গিনিপিগ, মানুষ) → ফুসফুস
  14. শামুকের ফুলকাকে → টিনিডিয়া বলে।

১০। প্রাণীদেহে শ্বসন অঙ্গ এবং শ্বসন পদ্ধতি (Respiratory Organs and Respiratory Process in Animals) : বৈচিত্র্যময় পরিবেশে প্রাণীদের শ্বাসযন্ত্র যেমন আলাদা তেমনি শ্বসন পদ্ধতিও আলাদা। সরল থেকে জটিল বিভিন্ন ধরনের শ্বসন কৌশল পরিলক্ষিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শ্বসন পদ্ধতির উল্লেখ করা হল।

1. দেহতল দ্বারা (By body surface) : সরলতম এই পদ্ধতি দ্বারা অনেক জল প্রাণী শ্বাসকার্য চালায়। এই সকল প্রাণীরা সমগ্র দেহতল দিয়ে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। যেমন—অ্যামিবা, স্পঞ্জ, ইউগ্লিনা, হাইড্রা ইত্যাদি।

2. ত্বকের সাহায্যে (By skin) : কেঁচো, জোঁক প্রভৃতি প্রাণীদের কিউটিকল নামক পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা ত্বক আর্দ্র এবং রক্তজালকপূর্ণ। এই রক্তজালকপুর্ণ ত্বক দিয়ে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ব্যাপন পদ্ধতিতে শোষণ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত করে। রক্তরসে দ্রবীভূত হিমোগ্লোবিন নামক শ্বাসরত্ত্বক রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে।

ব্যাঙের শীতঘুম?
  ব্যাঙের ত্বক ভিজে এবং অসংখ্য রক্তজালকপূর্ণ হওয়ায় প্রয়োজনে চামড়ার মাধ্যমে গ্যাসীয় আদানপ্রদান ঘটায়। শীতকালে ব্যাঙ যখন গর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে কাটায় এবং ফুসফুসীয় শ্বসনের হার কমে যায়, তখন ভিজে ত্বকের মাধ্যমে শ্বাসকার্য চালাতে থাকে। এইভাবে সারা শীতকাল নিশ্চল অবস্থায় অতিবাহিত করাকে ব্যাঙের শীতঘুম বা হাইবারনেশন (hybernation) বলে।

3. শ্বাসনালির দ্বারা (By trachea) : পতঙ্গ শ্রেণিভুক্ত প্রাণীদের প্রধান শ্বাসযন্ত্র শ্বাসনালি বা ট্রাকিয়া। দেহের দু-পাশে বক্ষদেশে দু-জোড়া এবং উদরদেশে আটজোড়া মোট দশজোড়া শ্বাসছিদ্র (spiracles) নিয়ে শ্বাসনালিগুলির উৎপত্তি। শ্বাসনালিগুলি অসংখ্য শাখা-শ্বাসনালি বা ট্রাকিওল (tracheole)-এ বিভক্ত হয়ে দেহমধ্যস্থ কলাকোশে ছড়িয়ে থাকে। শ্বাসছিদ্র দিয়ে গৃহীত অক্সিজেন শ্বাসনালির মাধ্যমে কোশান্তর রসে পৌঁছোয় এবং সেখান থেকে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় কলাকোশে প্রবেশ করে। একইভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড শ্বাসছিদ্রপথে বাইরে বেরিয়ে আসে। যেমন— আরশোলা, প্রজাপতি ইত্যাদি।


4. ফুলকা দ্বারা (By gill) : অধিকাংশ জলজ প্রাণীর (চিংড়ি, শামুক, ঝিনুক, মাছ ইত্যাদি) প্রধান শ্বাসযন্ত্র ফুলকা। এখানে মাছের শ্বাসযন্ত্র এবং শ্বসন পদ্ধতি আলোচনা করা হল । মাছের মস্তকের দু-পাশে শক্ত অস্থিবিশিষ্ট কানকো (operculum) দিয়ে ঢাকা ফুলকা গহ্বরে চারজোড়া ফুলকা (gills) থাকে । প্রতিটি ফুলকা একটি অক্ষ এবং অসংখ্য ফুলকাপাত (Gill filament) দিয়ে গঠিত। ফুলকাপাতগুলি রক্তজালকে পূর্ণ থাকায় লাল বর্ণের দেখতে হয়। মাছ মুখ দিয়ে অক্সিজেন যুক্ত জল গ্রহণ করার সময় ফুলকাগুলি জলে নিমজ্জিত হয়, ফলে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ফুলকার জালকে প্রবেশ করে এবং জালক থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড একই পদ্ধতিতে জলের মাধ্যমে কানকো দিয়ে বেরিয়ে আসে।

5. অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্রের দ্বারা (By accessory respiratory organs) : কই, শিঙি, মাগুর প্রভৃতি জিয়ল মাছের ফুলকা ছাড়াও বিশেষ ধরনের অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র থাকে। এই অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্রের সাহায্যে জিয়ল মাছ ডাঙায় তোলার পরেও বাতাস থেকে সহজে শ্বাসগ্রহণ করে বেঁচে থাকতে পারে। খাল, বিল, ডোবার জলে কম পরিমাণ অক্সিজেন দ্রবীভূত থাকায় মাঝে মাঝে এদের জলের ওপরে ভেসে উঠে বাতাস থেকে অক্সিজেন নিতে হয়। ফলে জিয়ল মাছ ফুলকা ও অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্রের সাহায্যে জল ও বায়ু উভয় পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র শ্বাসক্রিয়ার একটি পরিপূরক ব্যবস্থা মাত্র।

কই মাছের অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র মাথার দু-পাশে ফুলকার ঠিক ওপরে দেখতে অনেকটা গোলাপ ফুলের মতো। শিঙি মাছের ফুলকার পিছনে দেহকাণ্ডের পার্শ্বদেশে অবস্থিত অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র নলাকার এবং পৃষ্ঠপাখনা পর্যন্ত বিস্তৃত। মাগুর মাছের ফুলকা সংলগ্ন অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র শাখা-প্রশাখাযুক্ত বৃক্ষাকৃতি।


6. ফুসফুস দ্বারা (By Lungs) : সকল উন্নত শ্রেণির প্রাণীদের (উভচর থেকে স্তন্যপায়ী) শ্বাসযন্ত্র হল ফুসফুস। ফুসফুস প্রাণীদেহে বক্ষগহ্বরের মধ্যে এবং উদর গহ্বরের সম্মুখে অবস্থিত। ফুসফুস পুরা নামক দ্বিস্তরীয় আবরণ দিয়ে আবৃত। লাল রঙের ফুসফুস দুটি অসংখ্য বায়ুথলি বা অ্যালভিওলাই (alveoli) নিয়ে গঠিত। অ্যালভিওলাইগুলি রক্তজালক দ্বারা পরিবৃত। প্রতিটি ফুসফুস থেকে একটি করে নালি নির্গত হয়, এদের ব্রংকাস (bronchus) বলে। ব্রং কাস দুটি ট্রাকিয়া (trachea) বা শ্বাসনালির সঙ্গে যুক্ত। ব্রংকাস আবার ফুসফুসের মধ্যে ব্রংকিওল (bronchioles) বা উপক্লোম শাখায় বিভক্ত। শ্বাসনালির অগ্রভাগ ল্যারিংক্স (larynx)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্লটিস (glottis) বা শ্বাসছিদ্রের মাধ্যমে মুখবিবরে উন্মুক্ত। মুখবিবর অন্তঃনাসারন্ধ্র, নাসাপথ ও বহিঃনাসারন্দ্রের মাধ্যমে দেহের বাইরে উন্মুক্ত। 
নাসারন্ধ্র দিয়ে গৃহীত বায়ু মুখবিবর, গ্লটিস, ল্যারিংক্স, ট্রাকিয়া, ব্রংকাস ও ব্রংকিওল হয়ে বায়ুথলিতে প্রবেশ করে। এই সময় বায়ুথলি-মধ্যস্থ বায়ুর সঙ্গে রক্ত-জালকের রক্তের ব্যাপন প্রক্রিয়ায় গ্যাসীয় পদার্থের (O2 এবং CO2) আদানপ্রদান ঘটে। এরপর বায়ুথলি থেকে কার্বন ডাই- অক্সাইড বিপরীত পথে নিঃশ্বাস বায়ু হিসেবে দেহের বাইরে মুক্ত হয়। পাখিদের দীর্ঘক্ষণ উড্ডয়নের জন্য অতিরিক্ত শক্তির নিমিত্ত অতিরিক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজনে ফুসফুসের সঙ্গে ন-টি বায়ুথলি (air-sac) যুক্ত থাকে। দ্রুত শ্বসন চালানোর জন্য এই বায়ুথলিগুলি থেকে জমা অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহ হয়।

মানুষের শ্বাসযন্ত্র এবং শ্বসন পদ্ধতি : মানুষের শ্বাসঅঙ্গগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন – (A) মুখ্য শ্বাসযন্ত্র এবং (B) গৌণ শ্বাসযন্ত্র।

(A) মুখ্য শ্বাসযন্ত্র (Major respiratory organs) : মানুষের মুখ্য শ্বাসযন্ত্র যথাক্রমে একজোড়া ফুসফুস, একজোড়া ব্রংকাস, একটি ট্রাকিয়া, ল্যারিংক্স, গ্লটিস, নাসাপথ, অন্তঃনাসারন্ধ্র ও বহিঃনাসারন্ধ্র নিয়ে গঠিত।

1. ফুসফুস (Lungs) : মানুষের ফুসফুস দুটি বক্ষগহ্বরের মধ্যে মধ্যচ্ছদার ওপরে হৃৎপিণ্ডের দু-পাশে অবস্থিত। ফুসফুস দুটি ত্রিকোণাকার বা শাঙ্কবাকার। স্পঞ্জের মতো গোলাপি রঙের ফুসফুস দুটির মধ্যে ডান দিকেরটি তিনটি লতিযুক্ত (trilobed) এবং বাম দিকেরটি দুটি লতিযুক্ত (bilobed)। ডান ফুসফুস বাম ফুসফুস অপেক্ষা কিছুটা বড়ো। প্লুরা (plura) নামক দ্বিস্তরবিশিষ্ট আবরণ দ্বারা ফুসফুস আবৃত থাকে। এর ভেতরের স্তরটিকে ভিসারাল প্লুরা স্তর এবং বাইরের স্তরটিকে প্যারাইটাল প্লুরা স্তর বলে। স্তর দুটির মধ্যবর্তী স্থানকে অন্তঃপ্লুরা অঞ্চল বলে। অন্তঃপ্লুরা অঞ্চলে অবস্থিত তরল শ্বসনের সময় বক্ষও ফুসফুসের ঘর্ষণ নিবারণ করে। প্রতিটি ফুসফুসে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বায়ুথলি (alveoli) প্রায় সাড়ে ত্রিশ কোটি বর্তমান। ফুসফুসীয় ধমনি ও ফুসফুসীয় শিরা এবং তাদের শাখাপ্রশাখা অসংখ্য রক্তজালকে পরিণত হয়ে বায়ুথলিগুলিকে পরিবৃত করে রাখে। ফলে বায়ুথলিতে শ্বাসবায়ুর আদানপ্রদান ঘটে।

2. ব্রংকাস (Bronchus) : ফুসফুসের সঙ্গে যুক্ত ট্রাকিয়ার প্রধান দুটি শাখাকে ব্রংকাই (bronchi, একবচন ব্রংকাস) বা ক্লোমশাখা বলে। প্রতিটি ব্রংকাস ফুসফুসে প্রবেশ করে শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত হয়ে ব্রংকিওল বা উপক্লোমশাখা (bronchiole) এবং শ্বসন-উপক্লোমশাখা (respiratory bronchiole) গঠন করে। ব্রংকিওলের শেষভাগ স্ফীত এবং রক্তজালকে পরিবৃত হয়ে বায়ুথলি বা অ্যালভিওলাই (alveoli) গঠন করে শ্বাসবায়ুর (O2 এবং CO2) আদানপ্রদানে অংশ নেয়।
3. ট্রাকিয়া (Trachea) : ফুসফুসের বাইরে ব্রংকাস দুটি মিলিত হয়ে যে নালি গঠন করে, তাকে ট্রাকিয়া (Trachea) বলে। এটি 10-12 সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং 15-2 সেন্টিমিটার ব্যাসযুক্ত একটি স্থিতিস্থাপক নল বিশেষ। প্রায় 20টি ‘U’ আকৃতিবিশিষ্ট অসমাপ্ত তরুণাস্থি দ্বারা গঠিত অঙ্গুরি থাকায় বায়ু প্রবেশের সময় ট্রাকিয়া চুপসে যায় না।

4. ল্যারিংক্স (Larynx) : ট্রাকিয়ার অগ্রভাগে অবস্থিত ছোটো (44 mm দীর্ঘ এবং 43 mm ব্যাসবিশিষ্ট) নালিটিকে ল্যারিংক্স বা স্বরযন্ত্র বলে। এটি তিন খণ্ড তরুণাস্থি দ্বারা গঠিত ত্রিভুজাকার অঙ্গবিশেষ। স্বরযন্ত্রের মধ্যে অবস্থিত দুটি ভোকাল কর্ড (vocal cord) স্বর সৃষ্টি করে।

5. গ্লটিস (Glottis) : ল্যারিংক্সটি গলবিল অঞ্চলে একটি ছিদ্রের মাধ্যমে উন্মুক্ত থাকে, ছিদ্রটিকে গ্লটিস বা শ্বাসছিদ্র বলে। গ্লটিসটির ওপর তরুণাস্থি দ্বারা নির্মিত একটি ঢাকনা বা এপিগ্লটিস (epiglottis) থাকে, যা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের সময় শ্বাসছিদ্রকে বন্ধ করে দেয়।

6. গলবিল (Pharynx) : অন্তঃনাসারন্ধ্র এবং শ্বাসছিদ্রের মধ্যবর্তী ছোটো অংশটিকে গলবিল বলে। গলবিলের ওপর একটি ছোটো মাংসপিণ্ড আলজিহ্বা (Uvula) অবস্থিত, যা খাদ্য গ্রহণের সময় অন্তঃনাসারন্ধ্র দুটিকে ঢেকে দেয়।

7. নাসারন্ধ্র (Nostrils) : নাসিকা একজোড়া বহিঃনাসারম্ভ (external nostrils) ছিদ্রপথে বাইরে উন্মুক্ত থাকে। নাসারন্ধ্র দুটি একটি নাসিকা পাত (nasal septum) দিয়ে পরস্পর থেকে পৃথক। বহিঃনাসারন্ধ্র দুটি নাসাপথের মাধ্যমে মুখবিবরের ছাদে অবস্থিত দুটি অন্তঃনাসারন্ধ্রের (internal nostrils) দ্বারা গলবিল অঞ্চলে উন্মুক্ত থাকে। অন্তঃনাসারন্ধ্রের অগ্রভাগে আলজিহ্বা (Uvula) থাকে। মুখবিবর এবং গলবিল অন্তঃনাসারন্ধ্র ও গ্লটিসের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে।

(B) গৌণ শ্বাসযন্ত্র (Minor respiratory organs) : মানুষের গৌণ শ্বাসযন্ত্র বক্ষপিএর এবং শ্বসনে সাহায্যকারী পেশিসমূহ নিয়ে গঠিত।

8. বক্ষপিঞ্জর বা থোরাসিক কেজ (Thoracic cage) : বক্ষপিঞ্জর বক্ষগহ্বরের সম্মুখে অবস্থিত একটি উরঃফলক (Sternum) এবং দু-পাশে অবস্থিত বারো জোড়া পঞ্জর অস্থি- (ribs) দিয়ে গঠিত একটি খাঁচা বিশেষ। শ্বাস গ্রহণের সময় এই বক্ষপিঞ্জর প্রসারিত হয়।

 9. শ্বাসপেশি (Respiratory muscles) : পঞ্জার অস্থি-মধ্যস্থ পেশি এবং মধ্যচ্ছদা বা ডায়াফ্রাম (diaphragm) শ্বাসকার্যে সহায়তা করে। মধ্যচ্ছদা বক্ষগহ্বর এবং উদরগহ্বরের মাঝে অবস্থিত কিছুটা উত্তল মাংসল পর্দাবিশেষ, যার মাঝখানে একটি ছিদ্র দিয়ে গ্রাসনালি এবং মহাধমনি ও নিম্নমহাশিরা উদরগহ্বরে প্রবেশ করেছে। শ্বাস গ্রহণের সময় মধ্যচ্ছদা পেশি নীচের দিকে সংকুচিত হয়ে এবং পঞ্জর-মধ্যস্থ পেশি সংকুচিত হয়ে পঞ্জরগুলিকে পরস্পর থেকে বাইরের দিকে এবং ওপরের দিকে সরিয়ে দিয়ে বক্ষগহ্বরকে প্রসারিত করে ফুসফুসে বাতাস ঢুকতে সাহায্য করে।

মানুষের শ্বসন পদ্ধতি (Mechanism of Respiration in Man) : মানুষের শ্বসন প্রক্রিয়াটি দুটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। যথা : প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাস।
1. প্রশ্বাস বা শ্বাসগ্রহণ (Inspiration) : (i) শ্বাসগ্রহণ প্রক্রিয়ায় মধ্যচ্ছদা এবং বক্ষপঞ্জর-মধ্যস্থ পেশিসমূহ প্রধান ভূমিকা পালন করে। (ii) প্রশ্বাসের সময় মধ্যচ্ছদা সংকুচিত হয়ে নীচের দিকে নেমে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে বক্ষপঞ্জর-মধ্যস্থ পেশিসমুহ সংকুচিত হয়ে বক্ষ-পঞ্জরগুলিকে বাইরের দিকে এবং ওপরের দিকে তোলে, ফলে বক্ষগহুর দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে প্রসারিত হয়। (iii) বক্ষগহ্বর প্রসারিত হওয়ায় ফুসফুসের অন্তঃপ্লুরা অঞ্চলের চাপ কমে যায় এবং ওই সময় ফুসফুস-মধ্যস্থ বায়ুর চাপ বেশি থাকায় ফুসফুস দুটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে প্রসারিত হয়। (iv) প্রসারিত ফুসফুস-মধ্যস্থ বায়ুর চাপ কমে যাওয়ায় বাইরের অক্সিজেনযুক্ত বায়ু বহিঃনাসারন্ধ্র, নাসাপথ, অন্তঃনাসারন্ধ্র, মুখবিবর, গলবিল, গ্লটিস, ল্যারিংক্স, ট্রাকিয়া, ব্রংকাস ও ব্রংকিওলের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলিকে বায়ুপূর্ণ করে তোলে। এরপর বায়ুথলিতে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় রক্তজালকের রক্তের সঙ্গে বায়ুর আদানপ্রদান ঘটে। আসলে বক্ষগহুর প্রসারিত হয় বলেই ফুসফুসে বায়ু প্রবেশ করে।
2. নিশ্বাস বা শ্বাসত্যাগ (Expiration) : (i) শ্বাস গ্রহণের পর সমস্ত শ্বাসপেশিগুলি শিথিল হওয়ায় মধ্যচ্ছদা পুনরায় ওপরে উঠে আসে, ফলে বক্ষপঞ্জর আগের অবস্থায় ফিরে আসে। (ii) বক্ষগহ্বরের প্রাচীর প্রসারিত হওয়ায় ফুসফুসের ওপর চাপ পড়ে, ফলে ফুসফুস- মধ্যস্থ CO2 যুক্ত বায়ু বিপরীত পথে বহিঃনাসারন্ধ্র দিয়ে দেহের বাইরে বেরিয়ে যায়। বলা বাহুল্য, মস্তিষ্কের শ্বসনকেন্দ্র (respiratory centre) মোটর স্নায়ুর মাধ্যমে প্রশ্বাস গ্রহণ ও নিঃশ্বাস ত্যাগ প্রক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রণ করে।


শ্বসনের কার্য (Functions of respiration) :
1. শ্বাস বায়ুর আদানপ্রদান (Exchange of respiratory air) : শ্বসনের সময় প্রতিটি জীবকোশে অক্সিজেন পৌঁছোয় এবং শ্বসনজাত কার্বন ডাইঅক্সাইড দূরীভূত হয়।
2. শোষণ (Absorption) : ফুসফুসের মাধ্যমে O2, এবং CO2, ছাড়াও বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থ (যেমন—CO, NO ইত্যাদি) প্রাণীদেহে শোষিত হয়।
3. রেচন (Excretion) : শ্বসন প্রক্রিয়ায় অ্যামোনিয়া, কিটোন বড়ি, অ্যালকোহল, তেল, জলীয় বাষ্প প্রভৃতি বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় উদ্বায়ী পদার্থ দেহমুক্ত হয়।
4. অম্লত্ব ও ক্ষারত্বের ভারসাম্য রক্ষা (Balance of acidity and alkalinity) : দেহ থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হওয়ায় দেহকোশে অম্লত্ব ও ক্ষারত্বের ভারসাম্য রক্ষা হয়।
5. জলের ভারসাম্য রক্ষা (Balance of water) : শ্বসন প্রক্রিয়ায় দেহ থেকে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প বেরিয়ে যাওয়ায় দেহে জলের ভারসাম্য বজায় থাকে।
6. উষ্ণতার ভারসাম্য রক্ষা (Balance of temperature) : নিঃশ্বাসের সঙ্গে কিছু পরিমাণ তাপ দেহমুক্ত হয়, ফলে দেহে তাপের ভারসাম্য বজায় থাকে।
7. প্রকৃতিতে O2一CO2 ভারসাম্য রক্ষা (Balance of O2一COin nature) : শ্বসনে উৎপন্ন CO2 সালোকসংশ্লেষে ব্যবহৃত হয়। আবার সালোকসংশ্লেষে উৎপন্ন O, শ্বসনে ব্যবহৃত হয়। এইভাবে প্রকৃতিতে O2CO2এর ভারসাম্য রক্ষিত হয়।

১১। শ্বসনের তাৎপর্য বা গুরুত্ব (Significance of Respiration) : জীবদেহে জীবনের অস্তিত্ব প্রমাণ করে শ্বসন। জীবদেহে আমৃত্যু দিবারাত্র শ্বসন চলে। এই গুরুত্বপূর্ণ অপচিতি প্রক্রিয়াটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। 1. শক্তির মুক্তি (Release of energy) : (i) সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় যে সৌরশক্তি স্থৈতিকশক্তিরূপে খাদ্যের মধ্যে আবদ্ধ হয়, সেই শক্তি শ্বসন প্রক্রিয়ায় তাপশক্তি বা গতিশক্তিতে মুক্ত হয়ে জীবের বিভিন্ন বিপাকীয় ও শারীরবৃত্তীয় কার্যে, যেমন—পুষ্টি, বৃদ্ধি, রেচন, জনন, চলন, গমন ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিদিন প্রায় 2500 – 3000 kcal শক্তির প্রয়োজন, যা শ্বসন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়। (ii) শ্বসন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তি থেকে উষ্ণশোণিতবিশিষ্ট প্রাণীদের দেহ গরম থাকে, জোনাকি আলো দেয়, ইলেকট্রিক-রে মাছ দেহে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। ঘটনাগুলি শ্বসনে উৎপন্ন শক্তির রূপান্তর মাত্র।

2. অক্সিজেন এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডের ভারসাম্য রক্ষা (Maintenance of  O2一CO2 balance) : সালোকসংশ্লেষের সময় উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডল থেকে CO2 গ্রহণ করে এবং Oত্যাগ করে। ফলে পরিবেশে CO2 এর পরিমাণ কমে যাওয়ার এবং O2-এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু শ্বসনের সময় জীবকুল বায়ুমণ্ডল থেকে O2 গ্রহণ করে এবং CO2ত্যাগ করে। এর ফলে জীবজগতের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পরিবেশের O2CO2-এর ভারসাম্য বজায় থাকে।

সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসনের সম্পর্ক (Relation between Photosynthesis and Respiration) : সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসন একদিকে যেমন একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, তেমনি প্রক্রিয়া দুটি একটি অপরটির বিপরীত।

1. সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসন পরস্পর নির্ভরশীল : (i) সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরির সময় যে CO2-এর প্রয়োজন হয়, তার মূল উৎস জীবের শ্বসন প্রক্রিয়া। (ii) জীবের শ্বসনের জন্য যে খাদ্য এবং অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, তার মূল উৎস সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া। (iii) শ্বসনের সময় খাদ্য-মধ্যস্থ যে স্থৈতিকশক্তি গতিশক্তি বা তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়, সেই খাদ্য-মধ্যস্থ স্থৈতিকশক্তি উৎপন্ন হয় সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তির মাধ্যমে। (iv) সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসন দুটি বিপরীতধর্মী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশে O2CO2 ভারসাম্য রক্ষিত হয়। সুতরাং প্রক্রিয়া দুটি পরস্পর নির্ভরশীল।

2. সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসন পরস্পর বিপরীত প্রক্রিয়া : (i) সালোকসংশ্লেষ উপচিতি প্রক্রিয়া কিন্তু শ্বসন অপচিতি প্রক্রিয়া। (ii) সালোকসংশ্লেষে সৌরশক্তির আবদ্ধকরণের মাধ্যমে জৈবখাদ্য উৎপন্ন হয়, কিন্তু শ্বসনে সেই খাদ্য জারিত হয়ে আবদ্ধ শক্তি গতিশক্তিতে মুক্ত হয়। (iii) সালোকসংশ্লেষে জীবের শুষ্ক ওজন বৃদ্ধি পায়, কিন্তু শ্বসনে শুষ্ক ওজন হ্রাস পায়। ((iv) সালোকসংশ্লেষে COগৃহীত হয়, কিন্তু শ্বসনে COবর্জিত হয়। (v) সালোকসংশ্লেষে O2 মুক্ত হয়, কিন্তু শ্বসনে O2 গৃহীত হয়। (vi) সালোকসংশ্লেষে শক্তির স্থিতি হয়, কিন্তু শ্বসনে শক্তির মুক্তি ঘটে।

❐ সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসনের পার্থক্য (Difference between Photosynthesis and Respiration) :
সালোকসংশ্লেষ শ্বসন
1. সালোকসংশ্লেষ কেবলমাত্র ক্লোরোফিলযুক্ত কোশে দিনের বেলায় সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ঘটে 1. শ্বসন সজীব কোশে দিবারাত্র এবং সূর্যালোকের অনুপস্থিতেই ঘটে থাকে
2. এটি একটি গঠনমূলক অর্থাৎ উপচিতি বিপাক ক্রিয়া 2. এটি একটি ভাঙনমূলক অর্থাৎ অপচিতি বিপাক ক্রিয়া
3. সালোকসংশ্লেষ কোশীয় অঙ্গাণু ক্লোরোপ্লাস্টে সম্পন্ন হয় 3. শ্বসন কোশের সাইটোপ্লাজমে এবং কোশীয় অঙ্গাণু মাইটোকন্ড্রিয়ার মধ্যে সম্পন্ন হয়
4. এই প্রক্রিয়ায় CO2 গৃহীত হয় এবং O2  বর্জিত হয় 4. এই প্রক্রিয়ায় O2 , গৃহীত হয় এবং CO2 বর্জিত হয়
5. জল এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড সালোক-সংশ্লেষে কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় 5. গ্লুকোজ শ্বসনে কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়
6. এই প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ উৎপন্ন হয় 6. এই প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ জারিত হয়
7. খাদ্যবস্তু তৈরি হওয়ার ফলে জীবদেহের শুষ্ক ওজন বৃদ্ধি পায় 7. খাদ্যবস্তু দহনের ফলে জীবদেহের শুষ্ক ওজন হ্রাস পায়
৪. সৌরশক্তি স্থৈতিকশক্তিরূপে খাদ্যের মধ্যে আবদ্ধ হয় ৪. স্থৈতিক শক্তি গতিশক্তিরূপে মুক্ত হয়
9. সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াটি আলোক দশা ও অন্ধকার দশায় বিভক্ত 9. শ্বসন প্রক্রিয়াটি গ্লাইকোলাইসিস ও ক্রেবস চক্রে বিভক্ত
10. প্রক্রিয়াটি কার্বন ডাইঅক্সাইড-নির্ভর 10. প্রক্রিয়াটি কার্বন ডাইঅক্সাইড-নিরপেক্ষ
11. এই প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন নির্গত হয় 11. এই প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড ও জল নির্গত হয়
12. সালোকসংশ্লেষ একটি তাপগ্রাহী পদ্ধতি শ্বসন 12. শ্বসন একটি তাপমোচী পদ্ধতি

animated-new-image-0047  Read More Click Here 👇
  • সালোকসংশ্লেষ Study Notes
  • শ্বসন নোটস  Study Notes
  • পুষ্টি নোটস  Study Notes
  • সংবহন নোটস  Study Notes
  • চলন ও গমন নোটস  Study Notes
  • রেচন নোটস  Study Notes
  • স্নায়ুতন্ত্র নোটস  Study Notes
  • জ্ঞানেন্দ্রিয় নোটস Study Notes
  • হরমোন নোটস Study Notes  
  • কোশ ও কোশ বিভাজন Study Notes
  • জনন Study Notes
  • বংশগতি Study Notes
  • অভিব্যক্তি Study Notes
  • অভিযোজন Study Notes
  • ভাইরাস Study Notes
  • মাইক্রোবস্ Study Notes
  • রোগ ও স্বাস্থ্য Study Notes
  • পরিবেশ Study Notes
  • বাস্তুতন্ত্র Study Notes
  • সংরক্ষণ Study Notes
Latest Updated

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন