❐ ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনিক কাঠামো : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্রিটিশ সরকার ভারতে একটি সুদৃঢ় শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এই ব্যবস্থার তিনটি স্তম্ভ ছিল যথা—সিভিল সার্ভিস আমলাতন্ত্র, পুলিশি ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনী। বিচারব্যবস্থাও ছিল অন্যতম। এছাড়াও বিভিন্ন রেগুলেটিং অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিষয়গুলি যথার্থ রূপ পেয়েছিল।
১. আমলাতন্ত্র (সিভিল সার্ভিস) : ① 1784 খ্রি. পিটস্ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট' এবং 1793 খ্রি. সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতে সুনির্দিষ্ট আমলাতন্ত্র গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ② কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি রোধ ও দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি 'কর্নওয়ালিস কোড' প্রবর্তন করে সিভিল সার্ভিসের সূচনা করেছিলেন। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির ফলে সিভিল সার্ভেন্ট বা আমলাদের প্রয়োজন বোধ হয়। লর্ড কর্নওয়ালিসকে ভারতে “সিভিল সার্ভিসের জনক' বলা হয়। ③ লর্ড কর্নওয়ালিস কোম্পানির কর্মচারীদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক—দুটি শাখায় বিভক্ত করেন। ④ ভারতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসের প্রচলন করেন লর্ড ডালহৌসি (1853 খ্রি.)। 1922 খ্রি. থেকে ভারতে এবং ইংল্যান্ডে একই সঙ্গে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। ভারতের এলাহবাদে প্রথম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা আয়োজিত হয়। শুধুমাত্র ভারতে আয়োজিত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পরিচালনা করার জন্য ফেডেরাল পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠিত হয়। ⑤ লর্ড লিটন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ঊর্ধ্বসীমা 21 বছর থেকে কমিয়ে 19 বছর করেন। তিনি স্ট্যাটুইটারি সিভিল সার্ভিসের সূচনা করেন। লর্ড রিপন সিভিল সার্ভিসের ঊর্ধ্বসীমা 19 বছর থেকে 21 বছর করেন। ⑥ 1800 খ্রি. লর্ড ওয়েলেসলি ইংরেজ প্রশাসকদের ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্দেশ্যে ভারতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। 1802 খ্রি. কোম্পানির পরিচালকবর্গের আপত্তিতে কলেজটি বন্ধ হয়ে যায়। ⑦ চার্টার অ্যাক্ট (1833 খ্রি.) অনুযায়ী, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে নিযুক্তির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাস করা বাধ্যতামূলক করা হয়। চার্টার অ্যাক্ট, 1853-এর মাধ্যমে 18-23 বছর বয়সি ভারতের সকল জনসাধারণের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি ছিল।
২. সেনাবাহিনী : ① 1748 খ্রি. ক্যাপটেন এস লরেন্স ভারতীয়দের দ্বারা একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করেন। ② ভারতে সামরিক বিষয় তদারকির জন্য পিল কমিশন গঠিত হয়েছিল। ③ কর্নওয়ালিসের শাসনকাল থেকে সেনাবিভাগের কোনো উচ্চপদে ভারতীয়রা নিযুক্ত হত না। ④ 1856 খ্রি. সেনাবিভাগে 300 টাকার বেশি মাসিক বেতনপ্রাপ্ত ভারতীয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র 3 জন। ⑤ সামরিক কারণে দূরদেশে অবস্থানকালে ভারতীয় সিপাহিরা একটি অতিরিক্ত ভাতা বা বাট্টা পেত। এই অতিরিক্ত ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লর্ড ডালহৌসি। 'জেনারেল সার্ভিস এনলিস্টমেন্ট' নামক একটি আইনের মাধ্যমে প্রত্যেক সিপাহির প্রয়োজনে সমুদ্রপথেই বিদেশযাত্রা বাধ্যতামূলক করেন লর্ড ক্যানিং।
৩. পুলিশি ব্যবস্থা : ① ওয়ারেন হেস্টিংস প্রতিটি জেলায় একটি করে ফৌজদারি থানা ও থানাগুলিতে একজন করে দেশীয় ফৌজদার নিয়োগ করেন। ② কর্নওয়ালিস দারোগার হাতে আরক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব দেন যা পূর্বে জমিদারদের উপর ন্যস্ত ছিল। ③ ফৌজদার ছিলেন জেলার প্রধান পুলিশ কর্মচারী। প্রতিটি গ্রামে একজন চৌকিদার নিযুক্ত থাকত। ④ ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ পদ সৃষ্টি করেছিলেন। ⑤ 1843 খ্রি. সিন্ধু জয়ের পর স্যার নেপিয়ার সমগ্র সিন্ধ অঞ্চলকে একজন ইন্সপেক্টর জেনারেলের তত্ত্বাবধানে আনেন। তিনি প্রতিটি জেলায় ডিস্ট্রিক্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব্ পুলিশ (DSP) নিয়োগ করেন। 1860 খ্রি. পুলিশ কমিশনার নিয়োগ করা হয়। ⑥ 1802 খ্রি. মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ও 1804 খ্রি. ভারতের অন্যত্র দারোগা ব্যবস্থা চালু হয়। 1812 খ্রি. দারোগা ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটে।
৪. বিচারব্যবস্থা : ① ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রবর্তিত শাসননীতির দ্বারা বিচারব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিল। ② ওয়ারেন হেস্টিংস প্রতিটি জেলায় একটি করে দেওয়ানি ও একটি করে ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিটি বিচারালয়ে একজন ইংরেজ পরিদর্শক উপস্থিত থাকতেন। কলকাতায় দুটি আপিল আদালত—সদর দেওয়ানি ও সদর নিজামত আদালত প্রতিষ্ঠা করেন ওয়ারেন হেস্টিংস। 1774 খ্রি. কলকাতায় সুপ্রিমকোর্ট স্থাপিত হয়। ③ মেকলে ‘ভারতীয় পেনাল কোড'-এর রচনা করেন। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতীয় পেনাল কোড' (IPC) প্রবর্তন করেছিলেন এবং জনস্বার্থে সদর আদালত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ④ কোনো ভারতীয় বিচারক ইউরোপীয়দের বিচার করতে পারতেন না। 1883 খ্রি. লর্ড রিপন এই বৈষম্য দূর করতে ইলবার্ট বিল প্রবর্তন করলেও শ্বেতাঙ্গদের বিদ্রোহের ফলে সেই বিলের সংশোধন করতে বাধ্য হন।
❐ ভারতের ঔপনিবেশিক অর্থনীতি : ভারতের ঔপনিবেশিক অর্থনীতিকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা—মার্কেনটাইল পর্ব (1757-1813 খ্রি.), অবাধ বাণিজ্য পর্ব (1813-1860 খ্রি.) এবং পুঁজি বা মূলধন বিনিয়োগের পর্ব (1860 খ্রি. থেকে স্বাধীনতা অর্জন)।
(১) মার্কেনটাইল পর্ব [1757-1813 খ্রি.] : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই পর্বে একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকার কায়েম করে। বাণিজ্যিক স্বার্থে তারা আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল অধিগ্রহণ করে নতুন রাজস্ব নীতির প্রচলন করে। ভারতীয়দের অর্থ শোষণ করেই তারা ব্যবসাবাণিজ্য চালাতে থাকে। এইসময় সম্পদের বহির্গমন ঘটতে থাকে, যাকে দাদাভাই নৌরজি ‘Drain of Wealth' বলে অভিহিত করেছিলেন এবং কৃষক-শোষণও ব্যাপকমাত্রায় বৃদ্ধি পায়।
(২) অবাধ বাণিজ্যিক পৰ্ব [1813-60 খ্রি.] : ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এই অবস্থায় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং বাজার দখলের জন্য ভারত ছিল লোভনীয় অঞ্চল। এসময় ভারতীয় বস্ত্রশিল্প এবং অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে উচ্চহারে শুল্ক প্রয়োগ করা হয় এবং ভারতীয় কুটিরশিল্প অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। এই অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার চার্টার অ্যাক্ট (1813 খ্রি.) দ্বারা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকারের অবসান ঘটায় এবং ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ভারতে অবাধে বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে।
(৩) পুঁজি বা মূলধন বিনিয়োগের পর্ব [1860 খ্রি. – স্বাধীনতা অর্জন] : এই সময় ভারতে লর্ড ডালহৌসি কর্তৃক প্রথম রেলপথ ব্যবস্থার সূচনা হয়। 1850 খ্রি: থেকে ব্রিটিশরা নিজের দেশেই অন্যান্য শক্তি যেমন—ইউরোপীয় ও মার্কিনদের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ শিল্পপতিরা নিজের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হন। ভারত ছিল পুঁজি বিনিয়োগের নিরাপদ স্থান। এর ফলস্বরূপ ভারতে আধুনিক শিল্পের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ শুরু হয়। দেশীয় কুটিরশিল্প সম্পূর্ণভাবে অবহেলিত হয় ও দেশীয় শিল্পোদ্যোগীদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। আর্থিক শোষণ ব্যাপক রূপ নেয়, যার ফলে ভারতীয় অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই সময় লর্ড ডালহৌসি প্রবর্তিত গ্যারান্টি প্রথা-র মাধ্যমে ইউরোপীয় ছোটো ছোটো কোম্পানিগুলি প্রচুর অর্থ লাভ করেছিল।
❐ ঔপনিবেশিক আমলে বিভিন্ন রাজস্ব ব্যবস্থা : (১) পাঁচসালা বন্দোবস্ত (1772) : ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সময়ে প্রবর্তিত এই ব্যবস্থা অনুযায়ী যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ রাজস্ব নিলামের সময়) দিতে রাজি হত, তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। (২) একসালা বন্দোবস্ত (1777) : ওয়ারেন হেস্টিংস-এর আমলে প্রবর্তিত এই ব্যবস্থায় এক বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। ভারতে এই ব্যবস্থা 1789 খ্রি. পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। (৩) দশসালা বন্দোবস্ত (1789-90) : লর্ড কর্নওয়ালিসের সময়ে প্রবর্তিত দশ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্তের এই ব্যবস্থা 1789 খ্রি. 10 ফেব্রুয়ারি বাংলা ও বিহার এবং 1790 খ্রি. উড়িষ্যায় চালু করা হয়েছিল।
(৪) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (1793 খ্রি) : লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে এই বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। প্রথমে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা এবং পরবর্তীকালে বারাণসী, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কোনো কোনো অঞ্চলে এই প্রথা চালু হয়েছিল। প্রজাদের স্বার্থরক্ষায় 1859 খ্রি. ও 1885 খ্রি. নতুন আইন প্ৰণয়ন হয় যা প্রজাস্বত্ব আইন নামে পরিচিত ছিল।
❍ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার উদ্দেশ্য : (i) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিয়মিত রাজস্বের নিশ্চয়তা। (ii) ইংরেজ অনুগ্রহপুষ্ট নতুন অভিজাত শ্রেণির উদ্ভব, যারা ইংরেজ সমর্থক হবে। (iii) সরকার বাজেট নির্ধারণ করতে পারবে। (iv) জমিদাররা জমির স্বত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে কৃষির উন্নতিতে উদ্যোগ নেবে, এই বন্দোবস্ত অনুসারে—(i) জমির নিলামে সর্বোচ্চ দর দেওয়া জমিদাররা বংশানুক্রমিকভাবে ভোগ দখলের অধিকার লাভ করেছিল। (ii) বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে সরকারকে প্রাপ্য রাজস্ব মেটাতে হবে, না হলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে। এই নিয়মের জন্যই এই আইন সূর্যাস্ত আইন নামে পরিচিত ছিল। (iii) জমিতে কৃষকদের কোনো স্বত্ব ছিল না।
❍ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল – (i) এই আইনের ফলে নতুন অনুগত জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হয়। (ii) নির্দিষ্ট রাজস্ব অনুযায়ী বাজেট তৈরি করতে সুবিধা হয়। কিন্তু ক্রমশই কৃষকদের অবস্থার অবনতি হয়।
(৫) রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত (1820) : এটি ছিল কৃষকদের অর্থাৎ রায়তদের সঙ্গে সরকারের সরাসরি জমি বন্দোবস্তের আইন। এক্ষেত্রে 30/40 বছরের দীর্ঘমেয়াদি শর্তে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। এই বন্দোবস্তের প্রবর্তন করেন টমাস মুনরো। বোম্বে ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কয়েকটি অংশ ব্যতীত ভারতের বাকি অংশে এটি প্রবর্তিত হয়েছিল। এই বন্দোবস্তে সরকার স্থায়ী রাজস্ব নির্ধারণ না করায় তা ইচ্ছানুযায়ী বৃদ্ধি করা যেত, ফলে কৃষকদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলেও রাজস্বের হার না কমানোয় কৃষকরা মহাজনদের কাছে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ত। লর্ড মার্কুইস হেস্টিংস-এর সময়ে প্রবর্তিত এই ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ব ছিল না।
(৬) মহলওয়ারি বন্দোবস্ত (1822 খ্রি) : লর্ড মার্কুইস হেস্টিংসের সময়ে গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও মধ্য ভারতের কিছু অংশে এই বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। এই বন্দোবস্তের সূচনা করেন হল্ট ম্যাকেঞ্জি। এই ব্যবস্থায় কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি 'মহল' বা তুলুক তৈরি হত এবং 20 থেকে 30 বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। একজন বা কয়েকজন ব্যক্তিকে মহলের রাজস্ব আদায়ের ভার দেওয়া হত। এই ব্যবস্থাতেও রাজস্বের হার অত্যধিক হওয়ায় কৃষকরা শোষণ ও অত্যাচারের শিকার হত।
❐ ব্রিটিশ শাসনকালে প্রবর্তিত গুরুত্বপূর্ণ আইনসমূহ : (১) রেগুলেটিং অ্যাক্ট (1773 খ্রি) : 1773 খ্রি. ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘রেগুলেটিং অ্যাক্ট' বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আইন' পাস করে। এই আইনের শর্তানুযায়ী—(i) বাংলা প্রেসিডেন্সির গভর্নর মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সির ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার পান। (ii) ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত হন এবং গভর্নর জেনারেলকে সাহায্য করার জন্য 4 জন সদস্যবিশিষ্ট একটি কাউন্সিল গঠিত হয়, যার মেয়াদ হয় 5 বছর। এই কাউন্সিলের সদস্যরা ছিলেন— ক্লেভারিং, মনসন, বারওয়েল ও ফিলিপ ফ্রান্সিস। (iii) এই আইনে একটি সুপ্রিমকোর্ট গঠনের কথা বলা হয়।
(২) পিটের ভারতশাসন আইন (1784 খ্রি) : 1784 খ্রি. ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্ট' বা 'পিটের ভারত শাসন আইন পাস করেন। এই আইনের শর্তানুযায়ী — (i) 6 জন সদস্য দ্বারা ‘বোর্ড অব্ কন্ট্রোল' গঠিত হয়। (ii) বোর্ডের হাতে কোম্পানির যাবতীয় সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতা অর্পিত হয়। (iii) কোম্পানির 3 জন ডাইরেক্টরকে নিযুক্ত করে 'সিক্রেট কমিটি' গঠিত হয়। (iv) যুদ্ধ, শান্তি, রাজস্ব ও দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি বিষয়গুলি বিবেচনা করার জন্য বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ওপর গভর্নর-জেনারেলের ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করা হয়।
(৩) চার্টার অ্যাক্ট (1793 -1833 খ্রি) : 1793 খ্রি. ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রথম চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে 20 বছরের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের সনদ নবীকরণ করে। ‘বোর্ড অব্ কন্ট্রোলের' সদস্যসংখ্যা 6 থেকে হ্রাস করে 5 করা হয় ৷ 1833 খ্রি: এই আইন অনুসারে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার অবলুপ্ত হয়। অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের ভারতে বাণিজ্য করার অধিকার দেওয়া হয়। কোম্পানির আদায়কৃত রাজস্ব থেকে বার্ষিক 1 লক্ষ টাকা ভারতীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ব্যয় করার কথা ঘোষিত হয়।
❍ হাইলাইট কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :
- 1806 খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের নিকট হার্টফোর্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ” প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পরে তা হাইলেবেরিতে স্থানান্তরিত হয়। ভারতে আমলা পদে নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে সকল প্রার্থীদের এই কলেজে প্রশিক্ষণ নিতে হত।
- 1858 খ্রিস্টাব্দে হাইলেবেরির ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ' বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সিভিল সার্ভিস কমিশন ইংল্যান্ডে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে।
- প্রথম ভারতীয় হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন (1864 খ্রি.)।
- 1807 খ্রিস্টাব্দে তহশিলদারদের পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীকালে কালেক্টররা পুলিশ ব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে নিযুক্ত হন।
- 1861 খ্রিস্টাব্দে একটি সুনির্দিষ্ট পুলিশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এই কাঠামো অনুসারে গ্রাম ও শহরের পুলিশবাহিনী ডি এস পি-র নিকট, ডি এস পি ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজি) ও জেলাকালেক্টরের নিকট এবং জেলা কালেক্টররা প্রাদেশিক সরকারের নিকট দায়বদ্ধ থাকতেন।
- ব্রিটিশ শাসনের মার্কেনটাইল পর্বে ভারতীয় ব্যবসায়ীগণ এবং কুটির শিল্প ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণে ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
- ব্রিটিশ শাসনের অবাধ বাণিজ্যিক পর্বে ভারত ক্রমশ ইংল্যান্ডের শিল্পক্ষেত্রের চাহিদা পূরণের জন্য কাঁচামাল যোগানের কেন্দ্র এবং উৎপাদিত পণ্যের লোভনীয় বাজারে পরিণত হয়।
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে পত্তনিপ্রথার মাধ্যমে বহু মধ্যসত্ত্বভোগীর সৃষ্টি হওয়ায়, কৃষকদের উপর শোষণ বৃদ্ধি পায় এবং নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়।
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পরে বহু মানুষ ব্যবসাবানিজ্য ছেড়ে জমিদারি প্রথায় আত্মনিয়োগ করায় দেশীয় বাণিজ্যের ক্ষতি হয়। সূর্যাস্ত আইনের ফলে পূর্বেকার বহু জমিদারির উচ্ছেদ হয়।
- রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে ভূমিরাজস্বের হার ছিল উৎপন্ন ফসলের 45 থেকে 50 শতাংশ।
- 1793 সালের সনদ আইনে ভারতের রাজস্ব থেকে বোর্ড অব্ কন্ট্রোলের সদস্যদের বেতন ও ভাতা প্রদানের অধিকার দেওয়া হয়।
- 1813 সালের সনদ আইন অনুযায়ী, কোম্পানির সামরিক ও অসামরিক পদে নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে যথাক্রমে এডিসকোম ও হাইলেবেরি কলেজ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়।
- 1833 সালের সনদ আইন অনুযায়ী ‘বোর্ড অব্ কন্ট্রোল'-এর সভাপতি ভারত বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভায় স্থানলাভ করেন।
- 1853 সালের সনদ আইন অনুসারে বড়োলাটের অধীনে 12 জন সদস্য নিয়ে একটি আইন পরিষদ গঠিত হয় এবং যে কোনো আইন প্রবর্তনে গভর্নর জেনারেলের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়।
- 1861 সালের সনদ আইন অনুসারে আইন পরিষদের কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড়োলাট সম্মতি দিলেও ভারতসচিব তা বাতিল করতে পারতেন।
- 1909 সালের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কারে বলা হয় প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলির সদস্যসংখ্যা 30 থেকে 50-এর মধ্যে থাকবে এবং নির্বাচিত সদস্যসংখ্যার তুলনায় মনোনীত সদস্যদের সংখ্যা সর্বদা বেশি থাকবে। এই আইনের অধীনে গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নররা তাঁদের অপছন্দের যে-কোনো সদস্যকে আইন পরিষদ থেকে অপসারণ করার অধিকার লাভ করেন।
- 1919 সালের মন্টেগু-চেম্সফোর্ড শাসন সংস্কারে ভারতসচিবের কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা 4 থেকে বৃদ্ধি করে 12 জন করা হয়।
- 1935 সালের ভারতশাসন আইনে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচনের কথা ঘোষণা করা হয়। ভারতের আমলাতন্ত্রকে ব্রিটিশ শাসনের ইস্পাত কাঠামো' রূপে অভিহিত করেন পার্সিভ্যাল স্পিয়ার।
- 1772 খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (সূর্যাস্ত আইনের)-র কথা প্রথম বলেছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ।
- 1909 সালের মর্লে-মিন্টো আইন অনুসারে গঠিত বড়োলাটের কার্যনির্বাহক পরিষদের প্রথম সদস্য ছিলেন সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ।
- মহলওয়ারি ব্যবস্থা প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন আর এম বার্ড।
- 1861 সালের সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা প্রথমবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। লর্ড ক্যানিং তিনজন ভারতীয়কে গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলে মনোনীত করেন; তাঁরা হলেন—বেনারসের মহারাজা দেবনারায়ণ সিং, পাতিয়ালার মহারাজা নরেন্দ্র সিং, স্যার দিনকর রাও 1962 সালে এই কাউন্সিলে ভারতীয়দের সংখ্যা বেড়ে হয় 45।
- 1935 সালের ভারতশাসন আইন অনুসারে ভারতকে মোট 113 প্রদেশে বিভক্ত করা হয়।
- পাঞ্জাবে ভাইয়াচারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন লর্ড হেস্টিংস।
- 1919 সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি প্রভৃতি বিষয়গুলিকে নবগঠিত প্রাদেশিক আইনসভার নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ফলে ব্রিটিশ শাসনাধীনে প্রথম উক্ত বিষয়গুলি ওপর ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- 1854 খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা সংক্রান্ত খসড়ার রচয়িতা স্যার চার্লস উড ছিলেন ‘বোর্ড অব্ কন্ট্রোল’-এর প্রেসিডেন্ট।
- 1833 সালের সনদ আইনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্সি ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটে।
- লর্ড কর্নওয়ালিশ 4টি প্রাদেশিক ভ্রাম্যমান আদালত প্রতিষ্ঠা করেন।
- 1892 সালের সনদ আইনের মাধ্যমে প্রথমবার প্রদেশগুলিতে একটি নির্বাচিত আইনসভা স্থাপনের কথা বলা হয়।
- ভারতে প্রথম কেন্দ্রীয় আইনসভা প্রতিষ্ঠিত হয় 1920 খ্রিস্টাব্দে ।
- নন্দকুমারের ফাঁসির ঘটনাকে 'জুডিশিয়াল মার্ডার' বলে অভিহিত করা হয়।
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের সময় ‘বোর্ড অব্ রেভিনিউ'-এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন জন শোর। উল্লেখ্য চিরবন্দোবস্ত প্রবর্তনের সময় জন শোর ও উক্ত বোর্ডের হিসাব রক্ষক জেমস গ্রান্ট দুটি ভিন্ন পদ্ধতি প্রস্তাব করেন। লর্ড কর্নওয়ালিস জন শোরের পদ্ধতিটি গ্রহণ করেন।