☐ একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা
❍ সময়কাল: এপ্রিল 1, 2007 – মাৰ্চ 31, 2012 এই পরিকল্পনায় আর্থিক উন্নয়নের বার্ষিক হারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল 9%। কিন্তু 2008-09 এবং 2009-10 সালে বিশ্বে আর্থিক সংকটের ফলে এই হার কমিয়ে 8.1% করা হয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশ অর্থনৈতিক বিকাশে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা বা Inclusive Growth ছিল এই পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান বিষয়। এই পরিকল্পনার উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্যগুলি হল— GDP বৃদ্ধির হার ৪% থেকে 9%-এ বাড়ানো, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হ্রাস, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে স্কুলছুটের সংখ্যা হ্রাস, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, শিশুমৃত্যুর ও প্রসূতিমৃত্যুর হার আরও হ্রাস, সমস্ত গ্রামে বিদ্যুৎসংযোগ বৃদ্ধি, অরণ্য ও গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা অর্জন।
☐ দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা
❍ সময়কাল: এপ্রিল 1, 2012 – মাৰ্চ 31, 2017 দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল—দ্রুত, দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন (Faster Sustainable Development)। 2012 সালের 27 ডিসেম্বর এই পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। এটিই ভারতে গৃহীত শেষ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি: (i) GDP বৃদ্ধির হার ৪% ধার্য করা হয়েছিল। (ii) কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার 4% ধার্য করা হয়েছিল। (iii) নির্মাণ ও শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার যথাক্রমে 7.1% এবং 7.6% ধার্য করা হয়েছিল। (iv) পরিসেবাক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার 9% ধার্য করা হয়েছিল।
❍ দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান: (i) 2017 সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী জনসংখ্যা 10% হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল। (ii) খামারক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে 50 মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল।
❍ শিক্ষা: (i) দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিদ্যালয়স্তরে লিঙ্গ এবং সামাজিক বৈষম্য দূর করা, যেমন—ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ, তফশিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ না করা। (ii) দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের গড় সময়সীমা বাড়িয়ে অন্ততপক্ষে 7 বছর করার কথা বলা হয়েছিল। (iii) উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে 2 মিলিয়ন আসনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
❍ স্বাস্থ্য : (i) দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে ধার্য করা হয়েছিল প্রতি 1000 জন্মপিছু 25 জন এবং প্রসূতিমৃত্যুর হার কমিয়ে ধার্য করা হয়েছিল প্রতি 1000 জন্মপিছু 1 জন। 0-6 বছর বয়সি শিশুপুত্রের সংখ্যা 1000 হলে শিশুকন্যার সংখ্যা অন্তত 950 রাখার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল। (ii) মোট জন্মের হারকে 2.1-এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল।
❍ পরিকাঠামো: (i) দ্বাদশ পঙ্গুবার্ষিকী পরিকল্পনায় পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের হার GDP-র 9%-এ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল। (ii) 2017 সালের মধ্যে সকল ঋতু সড়ক (all-weather roads)-এর মাধ্যমে সমস্ত গ্রামের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করার কথা বলা হয়েছিল। (iii) 2017 সালের মধ্যে সমস্ত গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করার কথা এবং AT&C (Aggregate Technical and Commercial) ঘাটতির পরিমাণ 20%-এ নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল।
❍ পরিসেবা: (i) 2017 সালের মধ্যে 90% ভারতীয়দের কাছে ব্যাংকিং পরিসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল। (ii) আধার (Aadhar)-এর মাধ্যমে মুখ্য জনকল্যাণ সংক্রান্ত প্রকল্পের সুবিধা এবং ভর্তুকি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল।
✹ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল ভিত্তি বা মডেল :
- হ্যারড-ডোমার মডেল: প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল ভিত্তি। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইন্স-এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক মডেলের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতিবিদ ফোর্বস হ্যারড ও এভসে ডোমার এই মডেল প্রস্তাব করেন।
- মহলানবিশ মডেল: দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল ভিত্তি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক এই মডেলের প্রবক্তা হলেন রাশিয়ান অর্থনীতিবিদ গ্রিজোরি ফেল্ডম্যান ও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।
- সুখময় চক্রবর্তী-র ধারণা: তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল ভিত্তি অর্থনীতিবিদ জন স্যান্ডি ও সুখময় চক্রবর্তী এই ধারণা প্রবর্তন করেন।
- অশোক রুদ্রর ধারণা: চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল ভিত্তি। অর্থনীতিবিদ এ এস মান্নে ও অশোক রুদ্র এই ধারণা প্রবর্তন করেন।
- ধর মডেল: পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল ভিত্তি।
- জন ডব্লিউ মিলার মডেল: অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল ভিত্তি।
- গুনার মিরডাল মডেল: বহমান পরিকল্পনা বা Rolling Plan-এর মূল ভিত্তি।
(৩) নীতি আয়োগ (NITI Aayog) : 2015 সালের 1 জানুয়ারি, 65 বছরের পরিকল্পনা কমিশনের ইতি ঘটিয়ে নীতি আয়োগ তার যাত্রার সূচনা করেছে। এই সংস্থাটি পরিকল্পনা কমিশনের অনুকরণে, কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তক্রমে গঠিত হয়েছে। NITI Aayog-এর পুরো কথাটি হল— 'National Institution for Transforming India'। সংস্থাটি মূলত ভারত সরকারের ‘Think Tank’ হিসেবে কাজ করে।
❍ নীতি আয়োগের গঠন : সভাপতি—প্রধানমন্ত্রী পদাধিকারবলে এই সংস্থার সভাপতি নির্ধারিত হবেন। প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্যান্য সদস্যরা হলেন— ① একজন ভাইস চেয়ারপার্সন বা সহসভাপতি (প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত ; একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান পদমর্যাদা প্রাপ্ত), ② কয়েকজন পূর্ণসময়ের সদস্য, ③ কিছু বিশিষ্ট আমন্ত্রিত সদস্য, ④ একজন সি ই ও (প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত)। ⑤ অস্থায়ী সদস্য (বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান অথবা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ 2 জন), ⑥ পদাধিকারবলে সদস্য (অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ) ⑦ গভর্নিং কাউন্সিল—(সকল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (দিল্লি ও পুদুচেরিসহ), কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট জেনারেলগণ এই কাউন্সিলের সদস্য।) ⑧ অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি (CEO-র অধীনস্থ)।
বিশেষ কোনো অঞ্চলের সমস্যা আলোচনা করার জন্য গঠন করা হয়েছে রিজিওনাল কাউন্সিল (Regional Council)। NITI আয়োগের প্রথম চেয়ারপার্সন – নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী ভাইস চেয়ারপার্সন—অরবিন্দ পানাগরিয়া, চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (CEO)—অমিতাভ কান্ত। সংস্থার মূল উদ্দেশ্য— কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দেশবাসীকে উন্নততর পরিসেবা প্রদান।
✹ নীতি আয়োগের কার্য পরিচালনা : নীতি আয়োগের কার্য পরিচালনার জন্য ও টি শাখা রয়েছে— ① গবেষণা শাখা (Research Wing): বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে ‘থিংক ট্যাংক' তৈরি করে। ② উপদেষ্টা শাখা (Consultancy Wing) : কেন্দ্র সরকার ও রাজ্য সরকারগুলিকে পরামর্শ প্রদান করে। ③ টিম ইন্ডিয়া শাখা (Team India Wing) : জাতীয় সহযোগিতা মূলক শাখা।
☐ নীতি আয়োগের কার্য পরিচালনার 7টি স্তম্ভ হল—
① জনগণের অনুকূলে (Pro People): সমাজের বা ব্যক্তিবিশেষের আকাঙ্খা পূরণ। ② সক্রিয়তার অনুকূলে (Pro Activity): জনগণের চাহিদা সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা করে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ। ③ অংশগ্রহণ (Participation): নাগরিকদের নিযুক্ত করা বা অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করা। ④ ক্ষমতায়ন (Empowerment): সমস্ত দিক থেকে ক্ষমতা বৃদ্ধি করা (বিশেষত মেয়েদের)। ⑤ সকলের অন্তর্ভুক্তি (Inclusion of All): জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অন্তর্ভুক্তি । ⑥ সাম্য (Equality): সকলের জন্য সমান সুযোগ গ্রহণ । ⑦ স্বচ্ছতা (Transparency): সরকার (প্রশাসন)-কে স্বচ্ছ ও প্রতিক্রিয়াশীল রূপে গড়ে তোলা।
পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে নীতি আয়োগের গঠনগত ও কার্যগত কিছু অমিল রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রক ও রাজ্যগুলিতে তহবিল বণ্টনের যে ক্ষমতা পরিকল্পনা কমিশনের ছিল, তা নীতি আয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নীতি আয়োগের কোনো আর্থিক ক্ষমতা (Financial power) নেই। পরিকল্পনা কমিশনের সময়ে পরিকল্পনা নির্মাণ বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির ভূমিকা ছিল খুবই নগণ্য। কিন্তু নীতি আয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে পরিকল্পনা সংক্রান্ত সমস্ত ক্ষেত্রেই যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে কোনো অস্থায়ী সদস্য (Part-time Member) থাকার কোনো নিয়ম ছিল না, কিন্তু নীতি আয়োগে স্থায়ী ও অস্থায়ী উভয় সদস্যই থাকে। পরিকল্পনা কমিশনের কোনো CEO পদের সংস্থান ছিল না, নীতি আয়োগের ক্ষেত্রে CEO পদের সংস্থান রাখা হয়। CEO পদাধিকারীকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করেন।