ভারতীয় সংবিধানের উৎস এবং প্রস্তাবনা | ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা ও তার গুরুত্ব স্টাডি নোটস


ভারতীয় সংবিধানের উৎস এবং প্রস্তাবনা | ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা ও তার গুরুত্ব স্টাডি নোটস

ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতারা পৃথিবীর বহুদেশের সংবিধান থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি দেশের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় সংবিধানের কোনো কোনো বিষয়ের ওপর মার্কিন সংবিধানের প্রভাব খুব বেশি। আবার নির্দিষ্ট কতগুলি ক্ষেত্রে ভারতের সংবিধান কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আয়ার্ল্যান্ডের সংবিধানকে অনুসরণ করেছে। তবে গ্রেট ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত ভারতশাসন আইন, বিশেষত ভারতশাসন আইন, 1935 হল স্বাধীন ভারতের সংবিধানের প্রধান উৎস। বিদেশি সংবিধানগুলির শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য ও বিষয়গুলিকে ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয় প্রয়োজনের নিরিখে পরিবর্তনের পরে ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

উৎস : ভারতশাসন আইন, 1935
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :  ① যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো,② যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার ক্ষমতা, ③ রাজ্যপাল।
উৎস : গ্রেট ব্রিটেন
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :  ① সংসদীয় শাসনব্যবস্থা, ② আইনের শাসন ও আইন প্রণয়ন পদ্ধতি, ③ একক নাগরিকত্বের ধারণা, ④ দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, ⑤ লোকসভার নিকট মন্ত্রীসভার দায়বদ্ধতা, ⑥ লোকসভার স্পিকার, ⑦ প্রধানমন্ত্রী, ⑧ রাষ্ট্রপতি, নিম্নকক্ষ ⑨ পাবলিক অ্যাকাউন্টস্ কমিটি।
উৎস : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ : ① প্রস্তাবনা, ② মৌলিক অধিকার, ③ বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং বিচারবিভাগীয় পুনর্বিবেচনা, ④ সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ পদ্ধতি, ⑤ রাজ্যসভার চেয়ারম্যানরূপে উপরাষ্ট্রপতি, ⑥ অঙ্গরাজ্যের শাসনব্যবস্থা।
উৎস : সোভিয়েত রাশিয়া
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :  ① মৌলিক কৰ্তব্য, ② ন্যায়বিচার।
উৎস :  আয়ার্ল্যান্ড
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :  ① রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত সদস্য, ② রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি, ③ রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতিসমূহ।
উৎস : অস্ট্রেলিয়া
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :  ① যুগ্ম তালিকা, ② প্রস্তাবনার ভাষা,③ ব্যাবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত নিয়ম বা বিধি, ④ যৌথ অধিবেশন।
উৎস : কানাডা
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :  ① যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী কেন্দ্রের উপস্থিতি, ② কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতাবণ্টন এবং কেন্দ্রের হাতে অবশিষ্ট ক্ষমতা অর্পণ।
উৎস : দক্ষিণ আফ্রিকা
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :   ① সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি।
উৎস : জার্মানি
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :  ① জরুরি অবস্থা এবং জরুরি অবস্থা চলাকালীন মৌলিক অধিকার রদ-সংক্রান্ত নিয়ম।
উৎস : সুইডেন
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :  ① লোকপাল-সম্পর্কিত ধারণা।
উৎস : জাপান
সংবিধানে গৃহীত বিষয়সমূহ :  ① সুপ্রিমকোর্টের কার্যপরিচালনার নিয়মাবলি (Procedure established by law)।

❐ Read More ...

𒊹 প্রস্তাবনা : প্রস্তাবনা হল সংবিধানের ভূমিকা বা মুখবন্ধ। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতীয় সংবিধানের উৎস, লক্ষ্য এবং আদর্শগত ভিত্তি প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটি প্রকৃতপক্ষে একটি জনকল্যাণকারী রাষ্ট্রনির্মাণের শপথবাক্য। ভারতের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীরা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সুবিচার প্রাপ্তির নিশ্চিতকরণের যে আদর্শে বিশ্বাস করতেন সেই আদর্শের সংরক্ষণ ও বিকাশের সমবেত শপথ ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় উচ্চারিত হয়েছে।

𒊹ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা: “আমরা, ভারতের জনগণ, সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে সংকল্প করে ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সাধারণতন্ত্র (SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC) রূপে গড়ে তুলতে এবং দেশের সকল নাগরিক যাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার (JUSTICE) চিন্তা মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা (LIBERTY), মর্যাদা ও সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রে সাম্য (EQUALITY) ভোগ করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তিমর্যাদা, জাতিগত ঐক্য ও সংহতি (Unity and Integrity of the Nation)-র নিশ্চয়তা সাধন করার উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ (FRATERNITY)-এর প্রসারকল্পে, আজ 1949 সালের 26 নভেম্বর গণপরিষদে এই সংবিধান গ্রহণ ও বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।” প্রস্তাবনায় উল্লিখিত ‘আমরা, ভারতের জনগণ ...' (We, the people of India) বলতে বোঝানো হয়েছে যে, ভারতের সংবিধান রচনার আইনগত এবং নৈতিক ভিত্তি হল ভারতবর্ষের জনগণ। এই অর্থে জনগণই হল দেশের সংবিধানের মূল উৎস ও চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।

𒊹 প্রস্তাবনা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য : ① ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার ধারণা গৃহীত হয় আমেরিকার সংবিধান থেকে, যেটি পৃথিবীর প্রথম প্রস্তাবনা-যুক্ত সংবিধান। ②  ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটি জওহরলাল নেহরু খসড়া কমিটির সম্মুখে উত্থাপন করেন। ③ 1950 সালের 26 জানুয়ারি যখন ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হয়, তখন সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে বর্ণনা করা হয়েছিল সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্ররূপে। ④ 1976 সালে, 42 তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি—এই কথাগুলো সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আজ পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটি মাত্র একবার সংশোধন করা হয়েছে। ⑤ অত্যধিক সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় 1976 সালের 42 তম সংবিধান সংশোধনীকে Mini constitution বলা হয়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকাকালীন সংবিধানের প্রস্তাবনাটি সংশোধিত হয়েছিল। ⑥ বর্তমানে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্ররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ⑦ ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুসরণে রচিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রনেতাগণ প্রস্তাবনার ধারণাটি ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব্ হিউম্যান রাইটস্ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। ⑧ ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের আদর্শ ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ থেকে গৃহীত হয়েছে। ⑨ ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটিকে ভারতীয় সংবিধানের আত্মা বলে মনে করা হয়।

𒊹 প্রস্তাবনার সংশোধন যোগ্যতা: ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটি সংবিধানের একটি অংশ অথবা এটি সংশোধনযোগ্য কিনা সেটি সরাসরি ভারতীয় সংবিধানে উল্লেখ করা হয়নি। 1960 সালে বেরুবাড়ি মামলায় সুপ্রিমকোর্ট এই মর্মে রায় প্রদান করে যে, এটি সংবিধানের অংশ নয়। পরবর্তীকালে, 1973 সালে সংবিধানে প্রদত্ত বিচারবিভাগীয় পুনর্বিবেচনার অধিকার প্রয়োগ করে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিমকোর্ট নিজের পূর্ববর্তী রায় পরিবর্তন করে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাকে সংবিধানের অংশরূপে উল্লেখ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে মূল বৈশিষ্ট্যগুলির কোনোরূপ পরিবর্তন করা চলবে না। সুপ্রিমকোর্ট কেশবানন্দ ভারতী মামলার রায় বা তার বৈধতাকে আজ পর্যন্ত অপরিবর্তিত রেখেছে। পরবর্তীকালে (1995 সালে) LIC & India বনাম Consumer Education and Research Centre মামলাতেও রায়দানকালে সুপ্রিমকোর্ট প্রস্তাবনাকে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করে।
  • 1950 সালে এ কে গোপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে যে প্রস্তাবনা অনুসারে ভারতের জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
  •  প্রস্তাবনা সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে বিবেচিত হলেও এটি আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয় ৷
  • 13 ডিসেম্বর 1946 সালে জওহরলাল নেহরু গণপরিষদে যে উদ্দেশ্যমূলক প্রস্তাবটি (Objective Resolution) উত্থাপন করেছিলেন, সেটি 22 জানুয়ারি, 1947 সালে গণপরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এরই পরিবর্তিত ও পরিশীলিত রূপ হল ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা।
𒊹 প্রস্তাবনায় উল্লিখিত সাংবিধানিক মূল্যবোধ : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতীয় নাগরিকদের উদ্দেশ্যে কতকগুলি মৌলিক বা সর্বোচ্চ সাংবিধানিক মূল্যবোধের আদর্শ গৃহীত হয়েছে। এগুলি হল-সার্বভৌমত্ব, সমাজতান্ত্রিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, ন্যায়বিচার (অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক), স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতিগত ঐক্য ও অখণ্ডতা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন